তাইসির মাহমুদ:
শনিবার টাউন হলে শুরু হয়েছে দু’দিনব্যাপী বইমেলা । মেলাটির নাম দেওয়া হয়েছে- ‘লন্ডন বাংলা বইমেলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব” । বিকেলে ছিলো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান । এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ।
উদ্বোধনী পর্ব শেষে স্টেজ থেকে নেমে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের সাথে কুশল বিনিময় করছিলাম। কথা বলছিলাম প্রমিত বাংলায় । কিন্তু তিনি হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রশ্ন করলেন- আপনি সিলেটি না? বললাম, জ্বী..। বললেন, “তাহলে এতো কষ্ট করে শুদ্ধ বলার দরকার কি, সিলেটিই বলেন” । বললাম, “আপনি সিলেটি বুঝবেন?” বললেন, বুঝবো না মানে? আমার বাড়ি বানিয়াচং। এরপর সিলেটি ভাষায়ই অত্যন্ত আন্তরিকতায় আলাপ হলো।
ভালো লাগলো, মঞ্জুরুল ইসলামের মতো বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আরো একজন সিলেটির সাথে দেখা হতেই সিলেটি ভাষায়ই কথা বলতে চাইলেন । আঞ্চলিক ভাষার প্রতি তাঁর এ টান ও ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় এরকম আরো একটি ঘটনা দেখলাম । অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ডক্টর ইউনুস চট্রগ্রামে আমাদের এক সহকর্মী সাংবাদিক শাহনেওয়াজ রকিকে (চ্যানেল এস-এর সাবেক সিনিয়র রিপোর্টার) চট্রগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন । সাক্ষাৎকারে বলছেন, চট্রগ্রামে গেলে পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা হলে, অঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেই হয়। আঞ্চলিক ভাষায়ই তিনি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন।
যুক্তরাজ্যে ৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ১০ লাখের কাছাকাছি । কিন্তু ইংরেজির পরেই এখানে বাংলা ভাষাভাষীর অবস্থান। আর সেই বাংলা মানে, সিলেটি বাংলা। এখানে সিলেটি ভাষা জানলে সরকারি চাকরিতেও অগ্রাধিকার থাকে । তাই সিলেটি ভাষা অনেকটাই প্রবাসী বাংলাদেশীদের ‘জাতীয় ভাষা’র স্থান দখল করে আছে।
লন্ডনে একবার এক প্রয়াত সাংবাদিক-কলামিস্ট একটি টিভি সাক্ষাৎকারে এই বহুলচর্চিত সিলেটি ভাষাকে জংলি বলে তিরস্কার করেছিলেন । অবশ্য এ জন্য তাকে পরবর্তীতে মাফ চাইতেও হয়েছিলো।
সে যাক। বই মেলার উদ্বোধনী বক্তৃতায় যদিও আমরা বই পড়ার অনেক ‘ফজিলত’ বর্ণনা করেছি, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, আগতরা সাংস্কৃতিক উৎসব- তথা গান বাজনা ও নাচ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। বিশাল বিস্তৃত টাউন হলে হাতেগোনা ক’টি স্টল যেন অপাংক্তেয় হয়ে এক কোণে পড়ে আছে। জানিনা, ৮০/৯০’র দশকে বইপড়ার যে কালচার বা আগ্রহ ছিলো তা কি আর কোনোদিন ফিরে আসবে। নাকি মোবাইল ফোনে ‘টিকটক’ আর ‘রিলে’ দেখে আমাদের দিনের পর রাত কাটতে থাকবে?
টিকটকে সারারাত ছোট্ট ছোট্ট ভিডিও দেখবেন, কিন্তু সকালে ঘুম থেকে জেগে কিছুই মনে থাকবে না । তবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, একটি গল্পের বই পড়তে শুরু করুন । প্রতি রাতে অন্তত দুই পাতা করে পড়ুন । দেখবেন, যা পড়ছেন তা স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে । গল্পের কাহিনী, চরিত্রগুলো নিয়ে আপনার মধ্যে এক ভাবনার জগত তৈরি হবে ।
আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, যেখানে আমরা বইমেলার উদ্বোধন করলাম এই স্থানটিতে একসময় ছিলো যুক্তরাজ্যের প্রায় দুই শ’ বছরের পুরনো রয়েল লন্ডন হাসপাতাল ।২০০ বছরের ইতিহাসে এই স্থানে প্রথম কোনো বইমেলা হচ্ছে । এখানে আমাদের অনেকেরই অমোচনীয় স্মৃতি আছে । কেউ কেউ এই হাসপাতালে জন্ম গ্রহণ করেছেন । কেউ আবার সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
সেই হাসপাতাল স্থলে এখন টাউন হল হয়েছে । নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান সাহসী উদ্যোগ নিয়ে পরিত্যাক্ত হাসপাতাল ভবনটি ক্রয় করে এখানে টাউন হল করেছেন । তিনি একটি ঐতিহাসিক কাজ করেছেন । লুৎফুর রহমান ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন।
লন্ডন বাংলা বইমেলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক গোলাম মোস্তফার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কেবিনেট মেম্বার কাউন্সিলার কামরুল ইসলাম মুন্না, কবি-সংস্কৃতিকর্মী মুজিবুল হক মনি, বৃটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিক্ষাবিদ শাহগীর বক্ত ফারুক ও মেলা কমিটির সদস্য ফয়েজ আহমদ। ।
অনুষ্ঠান শেষে কাউন্সিলার কামরুল ইসলাম মুন্না নিয়ে গেলেন টাউন হলের প্রথমতলায় তাঁর কেবিনেট রুমে । নিজ হাতে চা বানিয়ে আনলেন । টাওয়ার হ্যামলেটসের পার্ক, লেজার সেন্টার ইত্যাদির উন্নয়ন ও সংস্কার নিয়ে অনেক কথা হলো । বইমেলা সফল হোক।
তাইসির মাহমুদ : জেনারেল সেক্রেটারি, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব । সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন । শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৪।