আনোয়ার শাহজাহান, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত:
দুবাইয়ে বাংলাদেশি প্রবাসীরা ব্যবসায় সাফল্য পাচ্ছেন, রিয়েল এস্টেট খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ এবং অন্যান্য খাতে প্রবৃদ্ধি
সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম শহর দুবাই, বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং বাণিজ্যিকভাবে শক্তিশালী নগরী হিসেবে পরিচিত। প্রাকৃতিক সম্পদ এবং শক্তিশালী অর্থনীতি ছাড়াও, দুবাই তার উদার ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং বিনিয়োগ সুযোগের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীরা এখানে এসে তাদের ব্যবসা শুরু করছেন। বাংলাদেশি প্রবাসীরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন এবং তাদের কৃতিত্ব দুবাইয়ের বাণিজ্যিক পরিবেশে আরও দৃশ্যমান হচ্ছে। আজকাল, তারা শুধুমাত্র কর্মী হিসেবে নয়, বরং উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করছেন।
■ দুবাইয়ে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ব্যবসায়িক যাত্রা:
বাংলাদেশি প্রবাসীদের ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু হয়েছে বহু বছর আগে, এবং তাদের ধারাবাহিক সাফল্য আজ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দুবাইতে এখন ব্যবসায়ী হিসেবে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি নজরকাড়া। ব্যবসায় তাদের অংশগ্রহণ শুধু বড় প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ছোট এবং মাঝারি ব্যবসাতেও তারা সফলতা পাচ্ছেন। হাইপারমার্কেট, রেস্টুরেন্ট, মোবাইল দোকান, স্বর্ণের দোকান, সেলুন, সুপারমার্কেট, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, স্টিল ওয়ার্কশপ, পারফিউম ফ্যাক্টরি, ইলেকট্রনিকস দোকানসহ একাধিক খাতে তারা বিনিয়োগ করছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রেস্টুরেন্ট এবং হোটেল শিল্পে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, যারা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম অর্জন করেছেন।
■ বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত: রিয়েল এস্টেট:
বর্তমানে, বাংলাদেশি প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছেন রিয়েল এস্টেট খাতে। দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট বাজার বিশ্বব্যাপী অন্যতম লাভজনক সেক্টর হিসেবে পরিচিত এবং বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এতে ব্যাপকভাবে অংশ নিচ্ছেন। সম্প্রতি, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা দুবাইয়ে রিয়েল এস্টেট সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট বাজারে বাংলাদেশের পরিচিতি বৃদ্ধি করেছে। তারা বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশি প্রবাসীদের সম্পত্তি ক্রয়ের প্রক্রিয়া সহজতর করছে।
■ বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের আরো উদ্যোগ: অন্যান্য ব্যবসা:
বাংলাদেশি প্রবাসীরা শুধুমাত্র রিয়েল এস্টেট বাজারেই নয়, অন্যান্য খাতেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে, এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিভিন্ন খাতে সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন। এই খাতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
এক. রেস্টুরেন্ট এবং ফুড চেইন: বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা দুবাইয়ে রেস্টুরেন্ট, কফি শপ এবং ফুড চেইন খুলে অত্যন্ত সফল হচ্ছেন। তারা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং আন্তর্জাতিক ফুড ব্র্যান্ডের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
দুই. স্বর্ণের দোকান ও গহনা তৈরি: অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী দুবাইয়ের স্বর্ণের বাজারে বিনিয়োগ করছেন, যেখানে তারা গহনা তৈরি এবং বিক্রি করছেন।
তিন. গার্মেন্টস এবং ফ্যাশন: বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা দুবাইয়ের গার্মেন্টস এবং ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছেন, বিশেষত তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড নিয়ে। তারা গার্মেন্টস তৈরির পাশাপাশি শোরুম এবং অনলাইন ব্যবসা চালাচ্ছেন।
চার. ইলেকট্রনিক্স এবং প্রযুক্তি: কিছু বাংলাদেশি ব্যবসায়ী প্রযুক্তি এবং ইলেকট্রনিক্স খাতেও ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তারা মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশন এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত পণ্য বাজারজাত করছেন।
পাঁচ. কনস্ট্রাকশন এবং নির্মাণ: বাংলাদেশের কনস্ট্রাকশন ব্যবসায়ী দুবাইয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নে অংশগ্রহণ করছেন। তারা নতুন আবাসন প্রকল্প এবং কমার্শিয়াল বিল্ডিং নির্মাণের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করছেন।
■ শাহ রিয়েল এস্টেট: বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ সহায়তা:
বাংলাদেশি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের রিয়েল এস্টেট খাতে সাহায্য ও সহায়তা প্রদান করছে, বিশেষ করে দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের জন্য যারা দুবাইতে বিনিয়োগ করতে চান। এই উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি শাহ রিয়েল এস্টেট। এই কোম্পানি বাংলাদেশের প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের প্রপার্টি কেনা-বেচায় সহায়তা করে যাচ্ছে এবং তাদের জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি সহজ করে তুলছে। শাহ রিয়েল এস্টেট, দুবাই ল্যান্ড ডিপার্টমেন্ট এবং দুবাই রিয়েল এস্টেট রেগুলেশন এজেন্সি কর্তৃক অনুমোদিত একটি প্রতিষ্ঠান, যা বাংলাদেশিদের জন্য নিরাপদ ও স্বচ্ছ রিয়েল এস্টেট লেনদেনের সুযোগ প্রদান করছে। এছাড়াও আরো কিছু বাংলাদেশি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি রয়েছে যারা এই সেক্টরে বাংলাদেশিদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। শাহ রিয়েল এস্টেট এলএলসি এর সিইও আনোয়ার শাহজাহানের মতে, দুবাইয়ের বাংলাদেশিরা প্রপার্টিজ ইনভেস্ট করে যে মুনাফা অর্জন করছেন সেই মুনাফা বাংলাদেশের পাঠিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নেও যথেষ্ট অবদান রাখছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কে করছেন বেগবান।
■ কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনীতিতে অবদান:
দুবাইয়ের বাংলাদেশি প্রবাসীরা শুধুমাত্র ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করছেন না, তারা একে অপরের জন্য কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করছেন। প্রায় ৫০,০০০ বাংলাদেশি প্রবাসী ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা পরিচালনা করছেন এবং এসব ব্যবসায় প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখের মত বাংলাদেশি কর্মসংস্থান পেয়েছেন। এইসব কর্মসংস্থান বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য দুবাইয়ের শ্রমবাজারে সুযোগ তৈরি করছে এবং তাদের জন্য নতুন জীবনের সূচনা ঘটাচ্ছে। এছাড়াও, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করছেন, যা দুবাইয়ের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
■ প্রতিবন্ধকতা: ভিসা জটিলতা:
তবে, বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, বিশেষত ভিসা সম্পর্কিত জটিলতা। অন্যান্য দেশের নাগরিকরা যেখানে সহজেই ভিসা পেয়ে যান, সেখানে বাংলাদেশিদের জন্য কিছুটা কঠিন এবং জটিল ভিসা প্রক্রিয়া রয়েছে। এই সমস্যাগুলোর কারণে অনেক ব্যবসায়ী তাদের প্রকল্পে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। সরকারের উচিত এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রবাসীদের জন্য সহজ ও স্বচ্ছ ভিসা প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যাতে তারা আরও সহজে ব্যবসা শুরু এবং পরিচালনা করতে পারেন।
■ প্রবাসী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের সহায়তা:
বাংলাদেশি প্রবাসীদের ব্যবসায়িক সাফল্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে যদি সরকার সঠিক নীতি গ্রহণ করে এবং প্রবাসী উদ্যোক্তাদের জন্য আরও নতুন সুযোগ তৈরি করে। বাংলাদেশের সরকার যদি দুবাইয়ের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ এবং সুরক্ষিত ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে, তবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আরও বড় বিনিয়োগে অংশগ্রহণ করবেন, যা দেশের অর্থনীতির উন্নতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে সহায়ক হবে।
■ ভবিষ্যতের সম্ভাবনা:
দুবাইয়ের বাংলাদেশি প্রবাসীরা এখন শুধুমাত্র ব্যবসায় সাফল্য পাচ্ছেন না, তারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাদের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দুবাইয়ের ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও শক্তিশালী হচ্ছে। ভবিষ্যতে, বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের আরও বড় ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতির জন্য একটি বড় ধরনের অবদান রাখবে।
সরকার যদি প্রবাসী উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তবে তা দেশের অর্থনৈতিক শক্তি বাড়াতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে।
■ আনোয়ার শাহজাহান
সিইও, শাহ রিয়েল এস্টেট, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত।