তাসলিমা খানম বীথি
সেদিন ছিলো ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ২০২৪। সাংবাদিক এক সহকর্মী অসুস্থ। তাকে দেখতে হসপিটালে যাই। তারপর সুবিদবাজার সোনার বাংলা সেন্টারে বিয়ের দাওয়াতে। তখনো প্রচন্ড গরম। টানা কয়েকদিনের তাপ প্রবাহে সিলেটে হাঁসফাঁস জনজীবন। তীব্র গরমের কারণে প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। গরম থেকে বাঁচতে নানা কৌশল নিচ্ছেন অনেকে। আমিও তীব্র গরম থেকে বাঁচতে ভাবছি বিয়ে সেন্টার থেকে বের হয়ে সোজা বাসা চলে আসবো। তার আগে কবি ইশরাক জাহান জেলীকে কল দেই। যেহেতু তার বাসা জালালাবাদ। কল দিতেই তিনি বললেন, আমিও ভাবছি। এত গরমে কীভাবে কাশবনে যাবো। শেষমেষ বললেন, বীথি তুমি আমার বাসা চলে আসো, পরে মনি আপার বাসা গিয়ে কিছুক্ষণ এসিতে বসে আড্ডা দিয়ে চলে আসবো। শুনে বলি- মনি আপার বাসা গেলেই কাশবনে যেতে হবে। এই গরমে আমার অসুস্থ হবার ইচ্ছে নেই। তিনিও নাছরবান্দা আমাকে বুঝিয়ে বশ করে বাসা আনালেন। জালালাবাদ থেকে জেলী ভাবী ও তার একমাত্র মেয়ে মেহেরিন, আমি সিএনজি করে ছুটলাম উপশহরে কবি রাহনামা শাব্বির চৌধুরী মনি আপার বাসায়। মাঝ পথে সিএনজি থামিয়ে কিছু নাস্তা কেনা হয়। উপশহরে চকচকে ঝকঝকে বাসভবনে লিফটে প্রবেশ করি। সেখান থেকে বের হয়ে কলিংবেল দিতেই দরজা খুলতে আমরা সোজা ড্রইংরুমে। মনি আপা ভেতর রুম থেকে এসেই স্নেহমাখা জড়িয়ে ধরে হট্টহাসি দিয়ে বললেন- ইয়া বীথি আইছোনি, আমি ত ভাবছি তুমি আইতা না। ভালা করছো আইছো। আপা বসতে বললেন। টেবিলে দুপুরে খাবার খেতে বসে যায় জেলী ভাবী ও তার মেয়ে আর আমি ঠান্ডা আইসক্রিম খেয়ে কিছুটা প্রশান্তি হলাম। এদিকে মনি আপা লাল কমলা মিক্স একটি শাড়ি পরে ঝটপট রেডি হলেন। নাতিপুতি মুখ দেখলোও মনি আপাকে কখনোই আমার কাছে বুড়ি মনে হয় না। তার তারুণ্যতা আমাকে উজ্জীবিত করে। মনি আপার বাসায় যাবার আগে ম্যাসেস দেই, বাইরে অনেক কড়া রোদ, গরমও বেশি। কাশবনে ভ্রমনে যেতে ইচ্ছে করছে না। সাথে সাথে তিনি ম্যাসেস উত্তর দিলেন, গরমে কিতা করতো। তুমি কম বয়েসি। আমরা অইলাম বয়স্ক। গরমে আমরারে ধরবো। এমন ম্যাসেস দিলেন না গিয়ে উপায় নেই।
2. গৌধুলী বিকেলে আমরা কাশবনের দিকে ছুটলাম। বাড়ির পাশে আরশি নগর। সাদা কাশবনে সমারোহে মন প্রাণে শরৎ দোলা হাওয়া নিতে যে কেউ ঘুরে আসতে পারেন প্রকৃতি টানে। কাশবনে ভেতর দিয়ে ছোট মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ জুড়ানো সাদা মেঘে রৌদ্রে উজ্জ্বল বিশাল আকাশের নিচে কাশবন। নরম তুলতুলে কাশবনকে স্পর্শ মনের শীতলতা এনে দিতে পারে একনিমিশেই। যদি কারো মন খারাপ ভালো করতে চান। ছুটে যেতে পারেন ভ্রমণ বিলাসি মন জুড়ানো কাশবনের দিকে। প্রকৃতিতে চলছে ঋতু বদলের রঙের ছোয়া। শরতের সেই রঙ রাঙিয়ে নিতে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে শরৎকালীন সাহিত্য আড্ডা ও কবিতা পাঠের আসর আয়োজন করলেন বিশ্ব বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ। সিলেট শহরের কাছেই এত চমৎকার কাশবন রয়েছে ভাবিনি। সংগঠনের সবাই সেখানে গিয়ে জড়ো হলাম।
3. খোলা আকাশের নিচে নরম মাটির আর সবুজ ঘাসের উপরে মাদুর বিছিয়ে সবাই বসে পরি। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। শুরু হয় আমাদের সাহিত্য আলোচনা। কবিতা গানের তালে লেখকরা হারিয়ে গেলেন ভুবন ভুলানো মুক্ত আকাশে বাতাসে। ফুটেছে কাশফুল। কী অপরূপ। শরতের শুভ্র মেঘে ঢাকা কাশফুল। আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। শহরের কোলাহল ছেড়ে ইট-পাথর থেকে বের হয়ে প্রিয়জনদের নিয়ে অনেকে ছুটে আসছেন শরতের কাশবন দেখতে। সবার মত আমারও শরৎ ভিষণ প্রিয় ঋতু। আষাঢ় শ্রাবন,শরৎ হেমন্ত আর বসন্ত জন্য সারা বছর আমি অপেক্ষা থাকি। এদিকে কাশবনে ভেতরে প্রকৃতিপ্রেমীরা ব্যস্ত ছবি তুলতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মেঘের সঙ্গে সূর্যের লুকোচুরিতে শরতের মায়াময় প্রকৃতি সাজে ভিন্ন রূপে। নীল আকাশে ধবধবে সাদা মেঘ আর মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া কাশবনে যে সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়ায় সত্যি এমন মুহুর্ত বারবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে।
৪.আনন্দময় মুহুর্ত দ্রুত চলে যায়। কখন যে মাগরিব হলো টেরই পাই না আমরা। কাশবনকে দেখছি আর শরৎ উপভোগ করছি। এর মাঝে কবি রওশন আরা বাঁশি আপুর ছেলে তার নববধুকে নিয়ে আড্ডা দেই। কাশবনে আসার আগে মনি আপা ও রোজী আপা সিঙ্গারা, কেক আরো দুই কবি বাসা থেকে চা বানিয়ে সাথে নিয়ে আসেন। খোলা আকাশের নিচে গরম রং চা সাথে মজাদার কেক, সিঙ্গারা আমাদের সাহিত্য আড্ডা জম্পেস হয়ে ওঠে। মাগরিবের আজান সুর ভেসে আসতেই দেখি চারিদিক থেকে পাখিদের কিচিমিচির তাদের নীড়ে ফেরা আনন্দ ডানা মেলে আমাদের মাথার উপর দিয়ে ছুটছে তো ছুটছে। এমন চমৎকার দৃশ্য এর আগে কখনো দেখিনি। মোবাইল দিয়ে অনেকে ছবি ভিডিও ধারন করে। আলো আঁধারি লুকোচুরি খেলায় মধ্যে দিয়ে শরৎকালীন কবিতা সাহিত্য আড্ডা উদযাপন শেষে পাখিদের মত আমরাও নীড়ে ফিরতে শুরু করি।