এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ: ধর্ষকদের রক্ষায় কোটি টাকার বাজেট!

 সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনার দুই মামলা থেকে ধর্ষকদের বাঁচাতে প্রায় কোটি টাকার বাজেট করা হয়। ওই টাকার মধ্য থেকে বাদীকে দেয়া হবে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ। আর বাকি অর্থ মামলায় খরচ করা হবে। আলোচিত মামলা থেকে ধর্ষকদের রক্ষা করতে এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে।

অবশ্য, মামলার বাদীকে আসামিপক্ষ ম্যানেজ করেছে বলেও গুঞ্জন ছড়িয়েছে। ঘটনা পরবর্তী ভিকটিমকে সহায়তাকারী মানবাধিকার কর্মীর একটি জিডি ওই গুঞ্জনকে আরও পাকাপোক্ত করেছে। বাদী মাইদুল ইসলাম মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ আকরাম আল সাহানকে হত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনায় থানায় জিডি করেন সাহান। এতে তিনি ৮০ লাখ টাকা বাদী গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ধর্ষকদের রক্ষায় কোটি টাকার বাজেট

সূত্র বলছে, এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে গণধর্ষণ মামলার আট ধর্ষককে মামলা থেকে বাঁচাতে তাদের টিলাগড় গ্রুপের নেতা রনজিত সরকার বহু চেষ্টা তদবির করেন। এক পর্যায়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার পরামর্শে বাদীকে ম্যানেজ করতে উদ্যোগী হন। এতে প্রয়োজন অর্থের। এ লক্ষ্যে নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় এক সিনিয়র আইনজীবীর বাসায় অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আট ধর্ষকের আত্মীয় স্বজনরা অংশ নেন। এতে সিদ্ধান্ত হয়, কোটি টাকার বাজেটের। আসামিদের প্রত্যেকে জনপ্রতি দশ লাখ টাকা করে দিতে হবে। পরবর্তীতে কোটি টাকা যোগাড় করার পরে ওই টাকা থেকে বাদীকে অর্ধেক টাকা দেয়া হবে। আর বাকী অর্ধেক টাকা বাদী ও আসামিপক্ষের আইনজীবী, কতিপয় সাংবাদিক এবং সংশ্লিষ্ট নেতাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়া হবে। প্রায় বছর খানেক আগে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বৈঠকের আলোকে তাদের কার্যক্রম পুরোপুরি অগ্রসর হচ্ছিল। আসামিদের রক্ষায় উচ্চ আদালতে লিভ টু আপিল দায়ের করা, মামলার বিচার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া, একটি গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ভিকটিম গৃহবধূ সম্পর্কে নেগেটিভ মন্তব্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা ছিল ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অংশ বিশেষ। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান তাদের সকল পরিকল্পনা যেন ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। জেলখানায় বন্দী ধর্ষকদের গডফাদারদের সবাই একে একে দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের কোটি টাকার পরিকল্পনা একেবারে ভেস্তে গেছে।

বাদীকে ম্যানেজের গুঞ্জন

চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার বাদীকে (যিনি কলংকজনক ঘটনার শিকার গৃহবধূর স্বামীও) নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আসামিদের গডফাদাররা বাদীকে অর্থের বদৌলতে ম্যানেজ করে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছেন বলেও গুঞ্জনের ডালপালা ছড়িয়েছে। এই গুঞ্জনের সাথে যোগ হয়েছে-আইনজীবীদের সাথে ক্রমশ বাদীর যোগাযোগ একেবারে কমিয়ে ফেলা। আইনজীবী প্যানেলের কল রিসিভ না করা। অথচ ঘটনার পর থেকে বিনা খরচে স্বেচ্ছায় আইনজীবী প্যানেল ওই মামলায় আইনী পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তবুও বাদী মাইদুল ইসলাম আসামিদের কাছ থেকে নগদ অর্থ গ্রহণ করেন বলে শোনা গেছে। এখানেই থেমে যাননি মাইদুল। আসামিদেরকে দেখতে একাধিকবার তিনি জেলখানায়ও গেছেন বলে ইতোমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে খবরও এসেছে।

বাদীর আইনজীবী প্যানেলের প্রধান আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরীও অর্থের বিনিময়ে বাদী ম্যানেজ হয়ে গেছেন তারা শুনেছেন বলে জানিয়েছেন।

মানবাধিকার কর্মীকে হত্যার হুমকি

বাদী মাইদুল ইসলাম গত ১৩ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ আকরাম আল সাহানকে হত্যার হুমকি দেন। এ ঘটনায় সাহান ১৪ সেপ্টেম্বর এসএমপির শাহপরান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি নম্বর-৭৮৩। জিডিতে সাহান লিখেন, “আমি নিম্ন স্বাক্ষরকারী সৈয়দ আকরাম আল সাহান। পিতা মৃত- সৈয়দ সুলতান আহমদ, সাং- আনন্দ- ৫ খরাদিপাড়া, শিবগঞ্জ, থানা- শাহপরাণ (রহ.), জেলা- সিলেট-এই মর্মে থানায় আসিয়া সাধারণ ডায়রী করার জন্য আবেদন করিতেছি যে, মাইদুল ইসলাম (২৮), পিতা- হাজী আব্দুল কাদির, ঠিকানা- জৈনপুর, ৩০নং ওয়ার্ড. দক্ষিণ সুরমা, সিলেট। গত ১৩/০৯/২০২৪ইং রোজ শুক্রবার রাত্র ১০ ঘটিকার সময় হোয়াটস অ্যাপ ০১৭৬৭৭১৬৭৯৪ নম্বর হইতে আমার হোয়াটস অ্যাপ নং ০১৭৪৮৯৯০১৪৮ তে নানা প্রকার কথাবার্তার মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন স্বরূপ হুমকি প্রধান করে এবং আমার স্ত্রী সন্তানকে খুন-জখমের মাধ্যমে আমাদের মরদেহ গুম করিবে ও বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করিবে বলিয়া উল্লেখ্য করে।”

আলোচনায় ৮০ লাখ টাকা

ওই জিডিতে মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ সাহান আরও লিখেছেন, “ উক্ত মাইদুল ইসলাম চাঞ্চল্যকর এমসি কলেজ হোস্টেলে গৃহবধূ ৮ জন ছাত্রলীগ কর্মী কর্তৃক গণধর্ষণের মামলার বাদী। সে উক্ত মামলার আসামিদের সাথে যোগসাজশ করে মামলার ব্যাপারে আপোষ করিয়াছে এই মর্মে ব্যাপক ধারণা প্রচলিত আছে। মাইদুল ইসলামের আচরণেও এটা বোধগম্য যে- উক্ত মামলার আসামিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখিয়াছে এবং আসামিদের নিকট হইতে ৮০ লক্ষ টাকা গ্রহণ করিয়াছে বলে অভিযোগ আছে।”

মানবাধিকারকর্মী সৈয়দ আকরাম আল সাহান বলেন, ঘটনার পর একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াই। মামলা পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ করে নিয়ে আসা, মানসিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে কাউন্সিলিং করা থেকে সবকিছু করেছি। কিন্তু হঠাৎ করেই শুনলাম বাদী টাকার বিনিময়ে আসামিদের সাথে আপোষ করেছেন। অথচ মামলাটি কোনোভাবেই আপোষযোগ্য নয়। এক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বাদী মাইদুল আমাকে হত্যার হুমকি দেন। আমি থানায় জিডি করেছি। এ রকম মামলা আপোষ হলে দেশে আইনের শাসন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে মন্তব্য তার।

এ সকল বিষয়ে বাদী মাইদুল ইসলামের বক্তব্য জানতে গত কয়েক দিন ধরে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। প্রথমে বার্তাকক্ষের টিএন্ডটি নম্বর থেকে বহুবার কল দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এরপর এ প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত সেল ফোন থেকেও অসংখ্যবার কল দেয়া হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ না করায় পরবর্তীতে তার হোয়াটসঅ্যাপে অর্থের বিনিময়ে আপোষের গুঞ্জন, মানবাধিকার কর্মীকে হত্যার হুমকি, আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াসহ আরও কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করে লেখা পাঠানো হয়। তার হোয়াটসঅ্যাপে এ সকল প্রশ্ন সিন হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।

শুরু থেকেই বিভ্রান্তির চেষ্টা পুলিশের

গণধর্ষণের ঘটনার পর থেকে পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে আসামিদের রক্ষার জন্যে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠে। যেখানে গণধর্ষণ ও চাঁদাবাজির বিষয়ে একই অভিযোগপত্র দেয়ার বিধান রয়েছে-সেখানে পুলিশ দুটো অভিযোগপত্র দেয়। এর ফলে মামলার বিচার বিলম্বে ফেলে দেয়া হয়। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, “যদি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের সহিত অন্য কোনো অপরাধ এমনভাবে জড়িত থাকে যে, ন্যায় বিচারের স্বার্থে উভয় অপরাধের বিচার একই সঙ্গে বা একই মামলায় করা প্রয়োজন, তাহা হইলে উক্ত অপরাধটির বিচার এই আইনের অধীন অপরাধের সহিত এই আইনের বিধান অনুসরণে একই সঙ্গে বা একই ট্রাইব্যুনালে করা যাইবে।”

মূলত মামলার সুপারভিশন কর্মকর্তা এসএমপির দক্ষিণ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এহসান চৌধুরীর চাপে পৃথক অভিযোগপত্র দেয়ায় মামলাটির বিচার বিলম্বিত হওয়াটা ত্বরান্বিত হয়। এই যেমন, ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি বাদীপক্ষ আদালতে দুটি মামলার বিচার কার্যক্রম একসঙ্গে শুরু করার আবেদন করলে বিচারক শুনানি শেষে আবেদনটি খারিজ করে দেন। এরপর বাদীপক্ষ মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম একই আদালতে সম্পন্নের জন্যে উচ্চ আদালতে একটি ফৌজদারি বিবিধ মামলা করেন। ফৌজধারি বিবিধ মামলা নম্বর -৮৯৫২/২০২১। তৎকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চ এ মামলার শুনানি করে মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম একসাথে একই আদালতে সম্পন্নের আদেশ দেন।

এদিকে, বাদীপক্ষের আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরীর সাথে নারী নির্যাতন আইনের ওই ধারা নিয়ে তুমূল বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তা এহসান চৌধুরী। ওই পুলিশ কর্মকর্তা কোনোভাবেই মানতে রাজী হননি যে ধর্ষণ ও চাঁদাবাজীর ঘটনায় একই অভিযোগপত্র দেয়া যায়।

আলোচিত এই মামলার সুপারভিশন কর্মকর্তা এহসান চৌধুরী ২০২৩ সালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) থেকে অবসরে গেছেন।

গতকাল বুধবার তার সাথে এ প্রতিবেদক কথা বলেন। এহসান চৌধুরীর দাবি, তিনি যথাযথ আইনগত দিক নির্দেশনার আলোকেই একই মামলার দুটো পৃথক অভিযোগপত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তিনি যা করেছেন তা আইনসম্মত। যদি আইনের ব্যত্যয় হয়ে থাকে এবং আদালত তাকে ডাকেন-তাহলে তিনি আদালতে এর ব্যাখ্যা দিতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সুত্র: সিলেটের ডা


সিলেট

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ: ধর্ষকদের রক্ষায় কোটি টাকার বাজেট!

নতুন সিলেট ডেস্ক :

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:১১

সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনার দুই মামলা থেকে ধর্ষকদের বাঁচাতে প্রায় কোটি টাকার বাজেট করা হয়। ওই টাকার মধ্য থেকে বাদীকে দেয়া হবে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ। আর বাকি অর্থ মামলায় খরচ করা হবে। আলোচিত মামলা থেকে ধর্ষকদের রক্ষা করতে এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে।

অবশ্য, মামলার বাদীকে আসামিপক্ষ ম্যানেজ করেছে বলেও গুঞ্জন ছড়িয়েছে। ঘটনা পরবর্তী ভিকটিমকে সহায়তাকারী মানবাধিকার কর্মীর একটি জিডি ওই গুঞ্জনকে আরও পাকাপোক্ত করেছে। বাদী মাইদুল ইসলাম মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ আকরাম আল সাহানকে হত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনায় থানায় জিডি করেন সাহান। এতে তিনি ৮০ লাখ টাকা বাদী গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ধর্ষকদের রক্ষায় কোটি টাকার বাজেট

সূত্র বলছে, এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে গণধর্ষণ মামলার আট ধর্ষককে মামলা থেকে বাঁচাতে তাদের টিলাগড় গ্রুপের নেতা রনজিত সরকার বহু চেষ্টা তদবির করেন। এক পর্যায়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার পরামর্শে বাদীকে ম্যানেজ করতে উদ্যোগী হন। এতে প্রয়োজন অর্থের। এ লক্ষ্যে নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় এক সিনিয়র আইনজীবীর বাসায় অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আট ধর্ষকের আত্মীয় স্বজনরা অংশ নেন। এতে সিদ্ধান্ত হয়, কোটি টাকার বাজেটের। আসামিদের প্রত্যেকে জনপ্রতি দশ লাখ টাকা করে দিতে হবে। পরবর্তীতে কোটি টাকা যোগাড় করার পরে ওই টাকা থেকে বাদীকে অর্ধেক টাকা দেয়া হবে। আর বাকী অর্ধেক টাকা বাদী ও আসামিপক্ষের আইনজীবী, কতিপয় সাংবাদিক এবং সংশ্লিষ্ট নেতাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়া হবে। প্রায় বছর খানেক আগে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বৈঠকের আলোকে তাদের কার্যক্রম পুরোপুরি অগ্রসর হচ্ছিল। আসামিদের রক্ষায় উচ্চ আদালতে লিভ টু আপিল দায়ের করা, মামলার বিচার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া, একটি গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ভিকটিম গৃহবধূ সম্পর্কে নেগেটিভ মন্তব্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা ছিল ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অংশ বিশেষ। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান তাদের সকল পরিকল্পনা যেন ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। জেলখানায় বন্দী ধর্ষকদের গডফাদারদের সবাই একে একে দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের কোটি টাকার পরিকল্পনা একেবারে ভেস্তে গেছে।

বাদীকে ম্যানেজের গুঞ্জন

চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার বাদীকে (যিনি কলংকজনক ঘটনার শিকার গৃহবধূর স্বামীও) নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আসামিদের গডফাদাররা বাদীকে অর্থের বদৌলতে ম্যানেজ করে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছেন বলেও গুঞ্জনের ডালপালা ছড়িয়েছে। এই গুঞ্জনের সাথে যোগ হয়েছে-আইনজীবীদের সাথে ক্রমশ বাদীর যোগাযোগ একেবারে কমিয়ে ফেলা। আইনজীবী প্যানেলের কল রিসিভ না করা। অথচ ঘটনার পর থেকে বিনা খরচে স্বেচ্ছায় আইনজীবী প্যানেল ওই মামলায় আইনী পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তবুও বাদী মাইদুল ইসলাম আসামিদের কাছ থেকে নগদ অর্থ গ্রহণ করেন বলে শোনা গেছে। এখানেই থেমে যাননি মাইদুল। আসামিদেরকে দেখতে একাধিকবার তিনি জেলখানায়ও গেছেন বলে ইতোমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে খবরও এসেছে।

বাদীর আইনজীবী প্যানেলের প্রধান আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরীও অর্থের বিনিময়ে বাদী ম্যানেজ হয়ে গেছেন তারা শুনেছেন বলে জানিয়েছেন।

মানবাধিকার কর্মীকে হত্যার হুমকি

বাদী মাইদুল ইসলাম গত ১৩ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ আকরাম আল সাহানকে হত্যার হুমকি দেন। এ ঘটনায় সাহান ১৪ সেপ্টেম্বর এসএমপির শাহপরান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি নম্বর-৭৮৩। জিডিতে সাহান লিখেন, “আমি নিম্ন স্বাক্ষরকারী সৈয়দ আকরাম আল সাহান। পিতা মৃত- সৈয়দ সুলতান আহমদ, সাং- আনন্দ- ৫ খরাদিপাড়া, শিবগঞ্জ, থানা- শাহপরাণ (রহ.), জেলা- সিলেট-এই মর্মে থানায় আসিয়া সাধারণ ডায়রী করার জন্য আবেদন করিতেছি যে, মাইদুল ইসলাম (২৮), পিতা- হাজী আব্দুল কাদির, ঠিকানা- জৈনপুর, ৩০নং ওয়ার্ড. দক্ষিণ সুরমা, সিলেট। গত ১৩/০৯/২০২৪ইং রোজ শুক্রবার রাত্র ১০ ঘটিকার সময় হোয়াটস অ্যাপ ০১৭৬৭৭১৬৭৯৪ নম্বর হইতে আমার হোয়াটস অ্যাপ নং ০১৭৪৮৯৯০১৪৮ তে নানা প্রকার কথাবার্তার মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন স্বরূপ হুমকি প্রধান করে এবং আমার স্ত্রী সন্তানকে খুন-জখমের মাধ্যমে আমাদের মরদেহ গুম করিবে ও বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করিবে বলিয়া উল্লেখ্য করে।”

আলোচনায় ৮০ লাখ টাকা

ওই জিডিতে মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ সাহান আরও লিখেছেন, “ উক্ত মাইদুল ইসলাম চাঞ্চল্যকর এমসি কলেজ হোস্টেলে গৃহবধূ ৮ জন ছাত্রলীগ কর্মী কর্তৃক গণধর্ষণের মামলার বাদী। সে উক্ত মামলার আসামিদের সাথে যোগসাজশ করে মামলার ব্যাপারে আপোষ করিয়াছে এই মর্মে ব্যাপক ধারণা প্রচলিত আছে। মাইদুল ইসলামের আচরণেও এটা বোধগম্য যে- উক্ত মামলার আসামিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখিয়াছে এবং আসামিদের নিকট হইতে ৮০ লক্ষ টাকা গ্রহণ করিয়াছে বলে অভিযোগ আছে।”

মানবাধিকারকর্মী সৈয়দ আকরাম আল সাহান বলেন, ঘটনার পর একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াই। মামলা পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ করে নিয়ে আসা, মানসিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে কাউন্সিলিং করা থেকে সবকিছু করেছি। কিন্তু হঠাৎ করেই শুনলাম বাদী টাকার বিনিময়ে আসামিদের সাথে আপোষ করেছেন। অথচ মামলাটি কোনোভাবেই আপোষযোগ্য নয়। এক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বাদী মাইদুল আমাকে হত্যার হুমকি দেন। আমি থানায় জিডি করেছি। এ রকম মামলা আপোষ হলে দেশে আইনের শাসন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে মন্তব্য তার।

এ সকল বিষয়ে বাদী মাইদুল ইসলামের বক্তব্য জানতে গত কয়েক দিন ধরে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। প্রথমে বার্তাকক্ষের টিএন্ডটি নম্বর থেকে বহুবার কল দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এরপর এ প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত সেল ফোন থেকেও অসংখ্যবার কল দেয়া হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ না করায় পরবর্তীতে তার হোয়াটসঅ্যাপে অর্থের বিনিময়ে আপোষের গুঞ্জন, মানবাধিকার কর্মীকে হত্যার হুমকি, আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াসহ আরও কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করে লেখা পাঠানো হয়। তার হোয়াটসঅ্যাপে এ সকল প্রশ্ন সিন হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।

শুরু থেকেই বিভ্রান্তির চেষ্টা পুলিশের

গণধর্ষণের ঘটনার পর থেকে পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে আসামিদের রক্ষার জন্যে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠে। যেখানে গণধর্ষণ ও চাঁদাবাজির বিষয়ে একই অভিযোগপত্র দেয়ার বিধান রয়েছে-সেখানে পুলিশ দুটো অভিযোগপত্র দেয়। এর ফলে মামলার বিচার বিলম্বে ফেলে দেয়া হয়। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, “যদি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের সহিত অন্য কোনো অপরাধ এমনভাবে জড়িত থাকে যে, ন্যায় বিচারের স্বার্থে উভয় অপরাধের বিচার একই সঙ্গে বা একই মামলায় করা প্রয়োজন, তাহা হইলে উক্ত অপরাধটির বিচার এই আইনের অধীন অপরাধের সহিত এই আইনের বিধান অনুসরণে একই সঙ্গে বা একই ট্রাইব্যুনালে করা যাইবে।”

মূলত মামলার সুপারভিশন কর্মকর্তা এসএমপির দক্ষিণ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এহসান চৌধুরীর চাপে পৃথক অভিযোগপত্র দেয়ায় মামলাটির বিচার বিলম্বিত হওয়াটা ত্বরান্বিত হয়। এই যেমন, ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি বাদীপক্ষ আদালতে দুটি মামলার বিচার কার্যক্রম একসঙ্গে শুরু করার আবেদন করলে বিচারক শুনানি শেষে আবেদনটি খারিজ করে দেন। এরপর বাদীপক্ষ মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম একই আদালতে সম্পন্নের জন্যে উচ্চ আদালতে একটি ফৌজদারি বিবিধ মামলা করেন। ফৌজধারি বিবিধ মামলা নম্বর -৮৯৫২/২০২১। তৎকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চ এ মামলার শুনানি করে মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম একসাথে একই আদালতে সম্পন্নের আদেশ দেন।

এদিকে, বাদীপক্ষের আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরীর সাথে নারী নির্যাতন আইনের ওই ধারা নিয়ে তুমূল বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তা এহসান চৌধুরী। ওই পুলিশ কর্মকর্তা কোনোভাবেই মানতে রাজী হননি যে ধর্ষণ ও চাঁদাবাজীর ঘটনায় একই অভিযোগপত্র দেয়া যায়।

আলোচিত এই মামলার সুপারভিশন কর্মকর্তা এহসান চৌধুরী ২০২৩ সালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) থেকে অবসরে গেছেন।

গতকাল বুধবার তার সাথে এ প্রতিবেদক কথা বলেন। এহসান চৌধুরীর দাবি, তিনি যথাযথ আইনগত দিক নির্দেশনার আলোকেই একই মামলার দুটো পৃথক অভিযোগপত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তিনি যা করেছেন তা আইনসম্মত। যদি আইনের ব্যত্যয় হয়ে থাকে এবং আদালত তাকে ডাকেন-তাহলে তিনি আদালতে এর ব্যাখ্যা দিতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সুত্র: সিলেটের ডাক

Visited 1 times, 1 visit(s) today
শেয়ার করুন