শেখ আব্দুর রশিদ ি:
পারস্য বিজয়ের সময় মহাবীর রুস্তমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে যখন নামিদামি সেনাপতি কাউকেই কাছে পেলেন না, তখন খলিফা ওমর সেনাপতি মনোনীত করলেন সাদ বিন আবু ওয়াক্কাসকে, যার যুদ্ধ পরিচালনায় কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে বিশাল পারস্যবাহিনী হাতি সামনে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সেনাপতি রুস্তম একটা উঁচু জায়গায় হাতির পিঠে হাওদায় বসে দূর থেকে আরব বাহিনীর জীর্ণশীর্ণ অবস্থা দেখে হাসছেন—এ তো কিছুক্ষণের খোরাক!
আবু ওয়াক্কাস বুঝলেন, সরাসরি যুদ্ধে সুবিধা করা যাবে না। তিনি আত্মনিমগ্ন হলেন। বুদ্ধি বেরিয়ে এলো। তীরন্দাজ প্রধানকে নির্দেশ দিলেন—সামনের যে হাতিটাকে অনুসরণ করে দুপাশের হাতিগুলো বল্লমের ফলার মতো এগোচ্ছে, ওটার দুই চোখে তীর মারতে হবে। সবচেয়ে দক্ষ তীরন্দাজ দল অবস্থান নিলো। প্রশিক্ষিত হাতির পাল এগিয়ে আসছে, হাতির পেছনে লাখো সৈন্য। ৫০ হাতের মধ্যে আসার সাথে সাথে দুজন তীরন্দাজ দুটি তীর মারলেন। দুটিই গিয়ে বিধলো নেতা হাতির দুচোখে। তীর ঢোকার সাথে সাথে অন্ধ হয়ে হাতি পেছনে ঘুরে গেল। নেতা হাতিকে দিক পরিবর্তন করতে দেখে বাকি হাতিগুলোও পেছনে ঘুরে গেল।
আরব বাহিনীর পরিবর্তে পুরো পারস্য বাহিনী হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বিপুল সংখ্যক সৈন্য হতাহত হলো। সেনাপতি রুস্তম হাতির হাওদা থেকে নেমে ঘোড়া নিয়ে পালাতে গিয়ে নিহত হলেন। জয়ী হলেন আরবরা। অর্থাৎ তাঁদের সুসজ্জিত বিশাল বাহিনী না থাকলেও নৈতিক শক্তিতে তাঁরা উজ্জীবিত ছিলেন। নতুন রণকৌশল অবলম্বনে অচিরেই তাঁরা দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন এবং বিজয় তাঁদেরই হয়েছে।
এই যুদ্ধ প্রমাণ করেছিল, সাহস, বুদ্ধি ও ঈমান যদি দৃঢ় হয়, তবে ক্ষুদ্র শক্তিও বৃহৎ সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করতে পারে।
১৯৭১ সালে তখনকার বিশ্বের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত পাকিস্তান বাহিনীকে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরাস্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল মাত্র নয় মাসে। যার যা ছিল তাই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এমনও হয়েছে—একজন ট্যাংক আসছে শুনে হাতে এয়ারগান নিয়ে ছুটে যাচ্ছে, ট্যাংক ঠেকাবে বলেই বিশ্বাস তার। এটাই ছিল স্বাধীনতার প্রতি অদম্য স্পৃহা।
২০২৪ সালের জাতীয় সংকটেও মানুষ বুক চিতিয়ে অন্যায় ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। কেউ পিছু হটেনি, কেউ পালায়নি।
১৯৪৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি দখলের বিরুদ্ধে লড়ছে। একসময় দেখা যেত, তরুণরা ট্যাংক দেখে পাথর ছুড়ে পালিয়ে যেত। কিন্তু আজ সেই প্রজন্ম বদলে গেছে। হামাসের যোদ্ধারা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ, বিমান হামলা আর অবরোধের মধ্যেও টিকে আছে। তাঁদের চারপাশে মৃত্যু, ধ্বংস, ক্ষুধা—তবুও তারা লড়াই ছাড়েনি। এই টিকে থাকা নিজেই এক বিরাট প্রতিরোধ।
কয়েকদিন আগে দেখা গেল এক ফিলিস্তিনি তরুণী—দুই বছরের যুদ্ধের মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে ফলাফল পেল। আনন্দে নেচেছিল সে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এইটুকু রেজাল্টের আনন্দে সে কিভাবে নাচতে পারে? লাখো শহীদ, পোড়া ঘরবাড়ি, নিহত শিশু ও মায়েদের স্মৃতি কি এত সহজে ভুলে যাওয়া যায়?
যুদ্ধবিরতি হলেই আমরা দেখি, অনেক ফিলিস্তিনি রাস্তায় নাচে, গান গায়। তারা কি স্বাধীনতার আনন্দে নাচে? না, তারা নাচে কারণ তারা এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু এই বেঁচে থাকার উল্লাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। ফলাফল পেয়ে যে তরুণী নেচে উঠেছিল, সে হয়তো এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেছে তার পিতার কবর, শহীদের রক্তে ভেজা মাটির গন্ধ। যুদ্ধবিরতির উল্লাসে যারা গান গায়, তারা হয়তো একফোঁটা জল ফেলতে ভুলে যায় সেই বুড়ো মানুষের জন্য, যিনি একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে প্রতিদিন তাকিয়ে থাকেন ধ্বংসস্তূপের দিকে।
ফিলিস্তিনিরা যতদিন এই ক্ষণিক আনন্দে বেঁচে থাকার তৃপ্তি খুঁজবে, ততদিন তারা প্রকৃত মুক্তির স্বাদ পাবে না। যুদ্ধবিরতির এই নাচগান যদি তাদের সংগ্রামের ধারাকে থামিয়ে দেয়, তবে স্বাধীনতা কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে। যারা আজ কেবল “বেঁচে আছি” বলেই উৎসব করে, তারা আসলে নিজেদের শেকড় ভুলে যাচ্ছে। এই আনন্দ যতদিন মৃত্যু ও ধ্বংসের বেদনাকে ঢেকে রাখবে, ততদিন তারা শত্রুর হাতে বন্দি থাকবে। ফিলিস্তিনকে মুক্ত হতে হলে তাদের আনন্দকে রক্ত, ত্যাগ আর প্রতিজ্ঞার ধারাবাহিকতায় রূপ দিতে হবে—যতদিন না তারা স্বাধীনতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়, ততদিন কোনো উৎসবই সত্যিকার আনন্দ নয়।
বিশ্বাসই মানুষকে জিতিয়ে দেয়। পারস্যের মরুভূমিতে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের জয়, এদেশের মুক্তিযোদ্ধার প্রতিরোধ, হামাসের টিকে থাকা—সবই বলে যায়: বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।