নাগরিক ভাবনা ২: দলীয় মনোনয়ন বনাম জনগণের পছন্দের প্রার্থী-

শাহাদত বখ্ত শাহেদ

গণতন্ত্রে বলা হয়, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। কিন্তু বাস্তবের রাজনীতিতে আমরা অনেক সময় এমন চিত্র দেখি, যেখানে জনগণের সেই উৎস-সত্তা দলীয় প্রভাব ও সিদ্ধান্তের নিচে চাপা পড়ে যায়। দল নির্ধারণ করে কে প্রার্থী হবে, আর জনগণ যেন বাধ্য হয়ে সেই প্রার্থীকে ভোট দেবে — এই মানসিকতা একবিংশ শতাব্দীতেও টিকে আছে। প্রশ্ন হলো, এটি কি সত্যিকার গণতন্ত্রের চিত্র?

জনগণ যাকে ভালোবাসে, তাকে ভালোবাসার পেছনে থাকে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা, আস্থা ও সেবার ইতিহাস। যে মানুষটি বিপদের দিনে পাশে থেকেছে, এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছে, সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে লড়েছে—তার প্রতি জনগণের ভালোবাসা স্বাভাবিক ও ন্যায্য। সে জনপ্রিয়তা রাতারাতি অর্জিত নয়; এটি সময়, ত্যাগ ও আন্তরিকতার ফসল।

কিন্তু যখন দলীয় উচ্চপর্যায় থেকে এমন একজন জনপ্রিয় ও যোগ্য প্রার্থীকে উপেক্ষা করে এমন কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, যার জনগণের সাথে যোগসূত্র দুর্বল, যার কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ, তখন জনগণের মনোভাব ক্ষুণ্ন হয়। তারা মনে করে, তাদের মতামতকে মূল্য দেওয়া হয়নি, তাদের অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলোরও নিজস্ব যুক্তি থাকে। তারা বলে—দলীয় শৃঙ্খলা, অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য, রাজনৈতিক কৌশল ইত্যাদি বিবেচনায় মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি সেই কৌশল জনগণের ইচ্ছার বিপরীতে যায়, তাহলে কি তা দলীয় স্বার্থ রক্ষা করে, নাকি ক্ষতি ডেকে আনে?

ইতিহাস সাক্ষী, জনগণের অপছন্দের প্রার্থী নিয়ে ভোটে নামলে দলীয় প্রতীক যত শক্তিশালীই হোক, জনগণের ভোটের ঢেউ তা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কারণ ভোটের বাক্সে দল নয়, মানুষ ভোট দেয় মানুষকে।

গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড জনগণ। তাদের মতামত, তাদের পছন্দ—এই দুটি বিষয়ই একটি নির্বাচনের আত্মা। যখন দলগুলো শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থী নির্ধারণ করে এবং তৃণমূলের মতামতকে অবজ্ঞা করে, তখন সেই গণতন্ত্রের শিকড় দুর্বল হয়ে পড়ে।

সময় এসেছে দলগুলোকে পুনরায় ভাবার—মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ কিভাবে বাড়ানো যায়। স্থানীয় পর্যায়ে “জনমত জরিপ”, “ওপেন প্রাইমারি”, “সার্ভে”—এসব পদ্ধতির মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রিয় প্রার্থীকে বাছাই করা সম্ভব। এতে দলও শক্তিশালী হবে, গণতন্ত্রও দৃঢ় হবে, আর জনগণও অনুভব করবে তারা সত্যিই ক্ষমতার অংশীদার।

রাজনীতির আসল লক্ষ্য ক্ষমতা নয়, সেবা। যে প্রার্থী জনগণের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে, তাকে উপেক্ষা করা মানে জনগণের স্বপ্নকে উপেক্ষা করা। দলীয় মনোনয়ন যদি জনগণের ইচ্ছার বিপরীতে যায়, তবে সেই মনোনয়ন কাগজে যতই বৈধ হোক, নৈতিকতায় তা শূন্য।

অতএব, জনগণের পছন্দকে মূল্য দেওয়া মানেই গণতন্ত্রকে সম্মান জানানো। কারণ জনগণই ক্ষমতার উৎস, আর সেই উৎসকে অবজ্ঞা করা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা।

৪ নভেম্বর -২০২৫

সিলেট।

শেয়ার করুন