লাল শাপলার বিল,শরতে ঝিলমিল

আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্  :

চার বিলের এক বিল-ডিবি বিল।ডিবি,ইয়াম,হরফকাটা ও কেন্দ্রী নামে হাওরে যুক্ত হলেও লাল শাপলা বা ইয়াম্বিল কে ডিবির হাওর নামে ডাকা হয়।কারণ একটাই- অত্র অঞ্চলে বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে হাওরের নাম না জানা মানুষের বসবাস বেশি।যদিও অত্র হাওরের সাথে জৈন্তিয়ার রাজকুমারী ইরা দেবীর স্মৃতির সংযোগ থাকায় হাওরের নাম দেবীর হাওর বলে ডাকা হতো।কিন্তু এর প্রাচীন নামটি হারিয়ে যাওয়াতে এই চার টি বিল কে একত্র করে উচ্চারিত শব্দের পরিধি বাড়বে বলে ইয়াম্বিল থেকে ডিবির হাওর বা ডিবির বিল নামে ডাকা হয়।কিন্তু মাত্র ৩০ বা ৩৫ বছর থেকে অত্র হাওর জুড়ে প্রতিটি বিলে লাল শাপলার রাজত্ব কায়েম হয়ে যাওয়াতে দর্শকরা মায়ার বাঁধনে লাল শাপলার বিল নামেই ডাকতে শুরু করেছেন।

চোখের এপার ওপার জুড়ে সাগরের মতো জলের গামলা বৃষ্টিহীনে স্থির আর বৃষ্টি-বর্ষায় অস্থির আফালে ভরপুর জলাভূমি সাগরের অপভ্রংশে সাগর থেকে হাওর নাম ধারণ করলেও,হাওর মূলত তাকেই বলা যায়-যে স্থানটি বিরাট এলাকা নিয়ে বর্ষাকালে প্লাবন ও শুকনো কালে কৃষি জমিনের যোগানদার যে জলাভূমিকে বাটি বা গামলার মতো মনে হয়।আর এই হাওরের বুকেই যে চারটি বিল তাদের অস্তিত্ব ধারণ করে আছে,তাদেরকে বিস্তৃত করলে বলা যায়-খাল বা নদীর পানির ঠিক বিপরীতে অবস্থানকারী হ্রদের মতো যে ভূমি জল ধারণ করে আছে স্থির অথচ অচঞ্চল তাকে বিল নামে ডাকতে পারি।তবে বিলের সাথে খালের সম্পৃক্ততার বয়ান হলো- প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট জল পরিবহনে সক্ষম জলাশয়কে খাল নামে অভিহিত করা যায়।যেহেতু দেবীর হাওর থেকে ইয়াম্বিল এবং ইয়াম্বিলের বর্তমান শাপলা বিল বলতে বলতে ডিবির হাওরের কথা বলছি,তাহলে আরেকটু খোলাসা করলে মন্দের নাগাল থেকে পার পাওয়া যায় বৈকি!

আমরা জানি,প্রাচীনকালে চন্দ্র,সেন এবং দেব রাজবংশের সময়কালে ব্যবহৃত শ্রীহট্র এবং সুলতানি আমলে নাম বদলীকরণের জালালাবাদ,এবং বর্তমানের সিলেট বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। যাকে ঘিরে আছে জেলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভারতের আসাম রাজ্য।আবার উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের মেঘালয় রাজ্য থাকলেও আমরা যে স্থানটি নিয়ে কথা বলতে চাই তার বাড়ি আবার পাহাড়-ঝর্ণার অপূর্ব মিশেল জৈন্তিয়া।মাপজোকে সিলেটের শহর থেকে ৪২ কিলোমিটারের পথ।জৈন্তিয়া রাজ্য আবার প্রতিবেশ উত্তর-পূ্র্ব ভারত যা বর্তমানে মেঘালয় শিলং মালভূমির পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণে সমভূমি আবার উত্তর দিকে ভারতের বরাক নদীর উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।জৈন্তিয়া শব্দটির আদি কথা ধার করতে গেলে বলা যায়,দেবী দূর্গার অবতার ছিলেন-জয়ন্তী দেবী বা জৈন্তেশ্বরী মন্দির।এ থেকে জৈন্তিয়া নাম নিলে পারা যেতো,তা ও নয়।এতে মতভেদের কথাও আমলে নিয়ে আরও মত দেওয়া যায়। জৈন্তিয়া নামটি তৎকালীন শাষকদের ভাষা পনার থেকে এসেছে কথাটিকেও আমলে না নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক রাজমোহন রায়ের কথা শুনতে হয়।তিনি বলেন,

জৈন্তিয়ার আদিকালে ‘টিসিন’ বংশের টিং থেকে সিনটেং ও পরে জৈন্তেন বা জৈন্তিয়া শব্দ আসে।২৩ জন স্বাধীন রাজা কর্তৃক শাসিত ১৭ পরগনা ও ২২ হাটির জৈন্তিয়ার রাজধানীর নাম ছিলো নিজপাট।আর সেখানের ই পাহাড়ের ওপারে আদিকালে ‘হোলোসিন’ যুগে অস্ট্রোএশিয়ার উপজাতিরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে খাসি এবং জৈন্তিয়া পাহাড় নামে পরিচিত অঞ্চলে অভিবাসিত ছিলো।আর তাদের নিজস্ব পাহাড় মেঘালয় ও ভারতে অবস্থানিক মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সাব সেক্টর নামে পরিচিত মুক্তারপুর থেকে উঁকি দিলে প্রায় ৯০০ একর এলাকাজুড়ে যে দেবীর হাওর বা ডিবির হাওর দেখা যায়,সেখানে তাঁরা মনসা পুজো সমাপ্তির পর লাল শাপলার ফুল,ডাটা,শিকড় ফেলে দিতেন।কেউ কেউ আবার পাহাড়ের পাদদেশে শাপলা সংরক্ষনের মানসে লাল শাপলা আর পদ্ম চাষে ব্রতী হন।ফলে পাহাড়ের ওপার থেকে ভেসে ভেসে বা স্থানীয় হাওরের জলা থেকে ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে লাল শাপলার ফুলে ফুলে।শুধু তা ই নয়,অত্র হাওরের মধ্যে বিদ্যমান থাকা প্রায় দুইশ বছরের অধিক বয়সী রাজা বিজয় সিংহের  মন্দিরের পূজারি থেকেও শাপলার বিস্তৃতি ঘটতে পারে বলেও ধরে নেওয়া যায়।কেনো না,এই দেবীর হাওরের ই বুক বরাবর ডুবিয়ে মারা হয়েছিলো ছত্র নারায়নের ভাগ্নে ও রাম সিংহের মামা বিজয় সিংহ কে।জানা যায় তৎকালীন জৈন্তিয়া কেন্দ্রীবিলের নৌকা দৌঁড়ের সময় ফুটির বাপের নৌকাতেই ছিলেন রাজা বিজয় সিংহ।ভাগ্য ভালো,১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ জৈন্তিয়া ব্রিটিশ করায়ত্বে আসায় লাল শাপলার বিল আমাদের হয়েছিলো বলে হোন্ডা সাইনকে রেডি করে নারিকেল পাতার ফাঁক গলে বাড়ির উঠোন বরাবর যে ভোরের আলো পড়ছিলো তাকে মাথায় নিয়েই রওয়ানা দিলাম একা একাই।৪০ কিলোমিটার থেকে ৬০ কিলোমিটারের ধারে কাছের স্পিড নিয়ে জৈন্তিয়ার বাজার ফেলেই হাতের ডান দিকে বিজিবি র ক্যাম্পের সাইনবোর্ড বরাবর নেমেই কোনাকুনি মেঠোপথে ১ কিলোমিটার পার করেই এসে গেলাম,চার বিলের এক বিল ডিবির বিলে।

এখানে শাপলার রাজত্ব বহু দিনের হলেও আমার আগমন অল্পে স্বল্পে।কিছুদিন আগেও যেখানে দেখেছিলাম হাওরের বুক চিরে আঁকাবাকা নৌকা সারি সারি।আজ দেখি,ঘাটে বাঁধা নৌকো।পর্যটকবিহীন বিরান বিল।৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে নৌকা ভাড়া হলেও ১০০ টাকায় শাপলা-পদ্মের বুক চিরে চিরে পাড়, মাঝপাড়ে ঘুরে ঘুরে যা দেখলাম,তাতে মন ভরে চোখ ভরে না। সেপ্টেম্বর থেকে লাল শাপলায় বিলের দখল নেওয়ার কথা থাকলেও বিল ভরে নি সবুজ পাতার লাল শাপলায়।হয়তো বৃষ্টির অপেক্ষায় আছে বিল।আছে শাপলার কলি।অথবা অপেক্ষায় আছে,আসবে নভেম্বর।আসবে পর্যটক।আসবে মোবাইলে ক্যামেরা।তবেই ফোটাবে শাপলার লাল-লালি।

আমরা জানি,শাপলা আবদ্ধ জলাশয়ের বারোমাসি ফুল।হাত বাড়ালেই শাপলার অস্তিত্ব দেশব্যাপী বিরাজমান বলে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ থেকে শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক হয়ে আছে।লাল,সাদা,গোলাপি,নীল বা বেগুনী নানা রঙের শাপলার মধ্যে আবার জাতীয় প্রতীকের জন্য সাদা শাপলাকেই বেছে নেওয়া হয়।কারন সাদা আত্মাকে পরিশুদ্ধকারী শান্তির আর ফুলের যুগলবন্দী  পাপড়ি দেশকে একত্রিকরণের প্রতীক বলে শাপলার কদর আকাশ ছোঁয়া।শ্রীলংকাও শাপলা থেকে মুক্ত নয়,তারা নীল শাপলাকে জাতীয় প্রতীক হিসেবে মান্য করে মাহানেল বলে ডাকে।ঋতুর রাজা বসন্ত কে ডাকলে রানীর চাহিদা মেঠায় শরতে।কেনো না শরৎ বেড়াতে এলে নদীঘাট,

বিলের পার,মাঠের মাঝ বরাবর ধুমধাম করে আসে।আনে উৎসব।আনে কাশফুল।আনে শাপলা।আনে পূজোর পদ্ম।আরাধনার শাপলা।আনে সুন্দর।ধরার শান্তি।শরৎ এলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথেও সখ্য নিয়ে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর জুড়ে শাপলার বিস্তারে জলের কোলে বিছানা পেতে আমাদের ডাকে।আমরা যাই।চোখ জুড়াই।ডাকে গ্রামীন জনপদের চাহিদার মানুষ।তারা শাপলা তুলে।শাপলার শেকড়ের শালুক তুলে।শাপলা নিয়ে হাঁটে যায়।পরিবারের অন্নের সাথে শাপলা মাখায়।শাপলা মাখায় বলে প্রতি ১০০ গ্রাম শাপলার মাঝে তারা খায় ১.৩ গ্রাম খনিজ পদার্থ।১.১ গ্রাম আঁশ। ১৪২ কিলোক্যালোরি খাদ্য প্রাণ।৩.১ গ্রাম প্রোটিন। ৩১.০৭ গ্রাম শর্করা। ৭৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম।ভিটামিন সি।বিডি।বি৭।আয়রন সহ আরও পায় গ্যালিক এ্যাসিড।ফলে ডাক্তার থেকে দূরে থাকে গ্রামীন জনপদের মানুষ।তাই শাপলার প্রতি আগ্রহাম্বিত মানুষের সংখ্যা বেশি।ফুলের প্রতি ভালোবাসাও বেশি বলেই হয়তো উষ্ম-আর্দ্র আবহাওয়ায় ফোটা শাপলা বাংলার বিলে-ঝিলে,হাওরে-বাওরে,পুকুরে-ডোবায় এ ফুল বাংলাদেশ জুড়ে টিকে আছে অনন্তকাল ধরে।যদিও আদিবাস আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশে তার অস্তিত্ব জানান দিতে গিয়ে মিশরকেও ছুঁয়ে এসেছে।এজন্য শাপলাকে নাইল,নাল,কুমুদ,ওয়াটার লিলি বা শালুক যা ই বলা হোক না কেনো,পৃথিবীর বয়েস যদি ৫৫৪ কোটি ধরা হয় তবে শাপলাই এ ধরায় বিরাজ করে আছে প্রায় ১৬ কোটি বছর ধরে।বৈজ্ঞানিক Nymphaea pubescens নামধারী এ শাপলা বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশের নাম ডাকে যুক্ত হলেও সারা পৃথিবীতে ই এর ব্যাপ্তী প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ প্রজাতির জানান দেওয়ার মাধ্যমে।গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্টটলের ভাবশিষ্য থিউফ্রাস্টাস এর মাধ্যমে আমরা  জানতে পারি প্রাচীন গ্রীসে জলদেবীদের মধ্যে শাপলাকে উৎসর্গ করে উপাসনার নিয়ম ছিলো।জৈন্তিয়ার লাল শাপলার বিলে আজ হতে প্রায় ৩২ বছর পুর্বেও যেখানে শাপলার দেখা মিলতো জার্মানি পানার মাস্তুলে আর পদ্ম ফুলের ফাঁকে ফাঁকে।এখন সেখানে মাঠ ভরা পানা নয়।হাওর ভরা মাছ নয়।শুকিয়ে যাওয়া বিলে ঘাস নয়-যে দিকে চোখ যায় লাল শাপলার বাহার দেখা যায়।আর দেখা যায় চোখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মের মায়াবি আলো।তবে পদ্ম বা শাপলার অভিন্ন প্রজাতির হলেও পদ্ম আর শাপলা হালকা মুশকিলের ব্যাপার।শাপলা পাতার আকার-২২ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার। বিস্তৃতি-০.৯ থেকে ১.৮ মিটার।৪ থেকে ৫ টি বৃতি ও ১৩ থেকে ১৫ টি পাপড়িযুক্ত এবং বৃতির মাপ-১১.১৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়।শাপলার পাতা গোলাকার। কিনারা ধারালো।পাতার উপরি অংশ ঘাড় সবুজ এবং নিচের অংশ কালো।পাতা পানির ওপর ভাসমান থাকলেও নিচের অংশ থাকে লম্বা ডাটার মাধ্যমে মাটির সাথে যুক্ত।তবে যা ই হোক শাপলা আবার পানি থেকে মুখ তুলে না।ঠিক পানির কাছাকাছি ভোরের আলো কে সাথে করে ফোটে এবং আলো বাড়ার সাথে সাথে পাপড়ি কে বন্ধ করে দেয়।অন্যদিকে ডিবির  বা দেবীর হাওরের লাল শাপলার ফাঁক গলে পদ্মকেও দেখা যায় মুখ তুলে হাসে।পদ্মের আদুরে নাম-মৃণাল,পঙ্কজ,অব্জ,অম্বুজ,নীরজ,সরোজ,সরসিজ,সররুহ,নলিনী,অরবিন্দ, রাজীব,ইন্দিরা,কমুদ,তামরস বলে ডাকলেও পদ্ম নামেই মজা পায় মানুষ।পানির উপর থেকে যে ফুল ২ মিটার উপরে ওঠে পর্যটক খুঁজে নেয় সে ই আসলে পদ্ম।পদ্মের আকৃতি শাপলা থেকে বড় ও গোলাকার।পাতার মাপ প্রায় ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।পাতাগুলো বড়,পুরু,গোলাকার এবং সবুজ রঙের হয়।এর বোঁটা থাকে লম্বা।ভেতর ফাঁপা।তবে মজার বিষয় হলো পদ্মপাতার উপরের অংশ পানিরোধী বলে সে নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে এবং গন্ধ  ছড়ায় বলে তাকে আধ্যাত্মিক জাগরণের প্রতীকও বলা হয়।তবে পদ্ম কে শাপলার বিল থেকেও আলাদা করা যায়।এ জন্য বড়ো প্রয়োজন অনুসন্ধানী চোখের।চোখ বাইরের আলোকে রেটিনার মাধ্যমে সংগ্রহ করে সংবেদন স্তরের মাধ্যমে ইলেকট্রিক সংকেতে রূপ দিয়ে প্রকৃয়াজাত করবে।এরপর কর্ণিয়া,লেন্স ও আইরিশের মাধ্যমে ছবি তোলে শাপলার লাল কে আরও লাল করে তুলবে ডিবির হাওরে।দেখে এলাম শাপলার মৌসুম কে কাজে লাগিয়ে ১ কিলোমিটারের  কাদামাখা পথ ইট সোলিংয়ে মাধ্যমে ফিরে যাচ্ছে নবতর রূপে।রাস্তা যেহেতু প্রস্তুত, আগন্তুকেরাও প্রস্তুতি নিলে মন্দ হয় না।

বাংলাদেশের যে কোন জেলা থেকেই আসা যায় মেঘালয় পাদদেশের এই লাল শাপলার বিলে।শুধু সুবহানীঘাট সিলেট থেকে জাফলংরোডের যে কোন গাড়ি ধরে জৈন্তাপুর বাজার থেকে কিছুদূর নামলেই হলো।এখানে সাদা সাদা বক,পানকৌড়ি,জল ময়ূরী আসে পাখনায় ভর করে আর পর্যটক আসেন গাড়ির চাকায় ভর করে।

শেয়ার করুন