আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্
নদীর নাম রাংপানি।স্ত্রীবাচক শব্দ ধারন করে প্রাকৃতিক স্রোত নিয়ে কোন পাহাড় বা পর্বত থেকে নেমে ভূমির শরীর ঘেঁষে সোজা যে জল সাগরে গড়ায় তার নাম নদী হলেও পুরুষবাচক নদ কিন্তু রাংপানির ধারে কাছে নেই।কারণ নদ, নদী নয়।নদ শাখা প্রশাখা ছাড়াই পানি তে ধায়।নদী আবার উল্টো তে।নদ নদীর এমন বিদ্যা আমলে নিয়ে স্বীকার করতে দ্বিধা করি না যে, পাহাড়িয়া ঢল বাওয়া রাংপানির পানিও যে নদী। নাম ধরে যার আদরনীয় এক নাম রাংপানি।
পানির সঙ্গদোষে রাংপানি লাল পলির আছাড়ি- পিছাড়িতে পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে পাথরকেও বলতো আয়; আমরা এক হয়ে যাই।তার এমনতরো আহবানে হয়তো পলিও রাঙতো।পাথর রাঙতো।রাঙতো প্রবাহমান নদীও।সূর্যরশ্মির বীক্ষণে সমুদ্রের পানি যেমন নীল হয়ে ওঠে,তেমন করে পলির মিশ্রনে রাঙা হয়ে ওঠতো রাঙা পানি।আর সীমান্ত ঘেঁষা এই অস্থির পানিতে পান ও প্রাণের তাগিদ মিঠাতে পাথর বেয়ে বেয়ে মালকোচো বা পায়ের সীমানা আলগা করে তার উপর দৌঁড়ে যেতো রাঙা রঙ্গিন পানি।সেখানে আবার রাঙা পানি পায়ের পাতায় নিয়ে বেড়াতো আসামপাড়া ও মোকামবাজারের মানুষ।লালে লালে রং মাখিয়ে দিতো পাথুরে রাস্তা।হয়তো সে-ই থেকে শুরু আজদিনের রাঙা পানির গল্প।ছোটো ছোটো পুঞ্জি মানে খাশিয়া বস্তি।সবুজে ছাওয়া আলপথ,মেঠোপথ কিংবা বাড়ির উঠোনে চলতো রাঙাপানির গল্প।তবে রাঙা পানি আর কতো ই বলা যায়!একদিন হয়তো এর উচ্চারণ লাগামে নিতে কেউ না কেউ একাকী বা সমস্বরে আদর করে ডেকেছিলো রাংপানি। সে ই থেকে এই নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে রাঙা পানি থেকে হয়তো রাংপানি হয়ে ওঠা এ রকম একটি নাম পাথরে।দূরন্ত গতির ছড়ায়।তুমুল বেগে আছড়ে পড়া ঝরণা হয়ে। পড়ে পাথরের বুকে বুকে ছল ছল বা ছলাৎ করে।ঝরে ঝরে আছড়ে পড়ে একেবারে বাংলাদেশের বুক বরাবর।তার বুকে আবার সুদূর বা নিকট অতীতে নানা সিনেমার স্যুটিং হলেও কিছুদিনের জন্য একবার ঝলক দিয়েছিলো শাবনাজ-নাঈম অভিনীত এহতেশামের চাঁদনী সিনেমা।তারপর গায়ের জোরে গায়েব হয়ে যায় রাংপানি।পড়ে পাথর খেকোদের হাতে।লুট হয় পাথর।এক ফুটের জমা পানির গর্তের মাপ বাড়ে দশে বিশে। তেমন তৃষ্ণা মিটাতে পর্যটন এলাকা গড়ার মতো দমিত ইচ্ছাটুও আড়ালে চলে যায়। কেবল অচেনা হয়ে ওঠে রাংপানি সীমানার জল আর রাঙা পাথর ভূমি।দিনে পাথুরে অপরাধ লাগাম ছাড়ে আর আলোচনায় আবারও আসে রাংপানি।কিন্তু অতীতে হালকা দূর্গম এলাকা মনে নিয়ে রাংপানি লুকিয়ে ছিলো এতোদিন!অজানা বা জানার লুকোচুরিতে এলাকাবাসী ছাড়া সিলেটের অগুন্তি পর্যটক বুকের অলিন্দে লুকিয়ে রেখে কিপ্টামো করলেও মনে হয় এমন কিপ্টামো আমার পক্ষে বোকামিই মনে হলো। তাই মনজ-দোকানের
ঝাঁপ তুলে,পুবের আকাশ থেকে একটা সূর্যকে ধার করে নিলাম- আয় বাবা! আমাদের সাথে চল।রাংপানিতে গিয়ে না হয়,শখের মোকাম রেখে পশ্চিমে যাবি!তা-ই করলাম।আশি-আশি করে চারটি আশির সংখ্যা জড়ো করে ৩২০ টাকা ভাড়াতে মিছবাহ্,ধ্রব,রুহী,মনজুর মিলে চারজনের সিলেট দুবড়ির হাওরপাড়ের সুবহানীঘাট থেকে লোকাল বাসে করে যাত্রা ছিলো কম টাকায় বেশি পাওয়ার মতো।প্রথমায় ঘুরেও এলাম রাংপানি।
সকাল নয়টায় গাড়ি শ্রীপুর মোকামপুঞ্জির রাস্তায় ইঞ্জিনকে মিনিটের রেস্টে বললো;নামেন।আমরা নামলাম।পায়ে পায়ে প্লাস্টিকের জুতা।মাথায় মাথায় ৩৫ ডিগ্রি সূর্যের আলট্রাভোয়োলেট নিরোধক ছাতা এবং চার চোখে চার জোড়া রোদচশমা নিয়ে পায়ের পাতালে মাটি ফেলে কখনও কাদার পিচ্ছিল,আবার কখনও বা পানির স্থিরতা ভেদ করে যেখানে এলাম-তার সাথে শরীরে ধারণ করা প্রায় ৫০ থেকে ৭০ লিটার পানির ও মিলন হলো।পানিতে পানিতে শরীরে বাহিত স্থিরবিদ্যুৎ ও মনোরাজ্যে উদ্ভাসিত তরঙ্গ এনে দিলো।পলকে দেখে নিলাম রাংপানিতে কেমন জানি বিছানা পাতা বিছনাকান্দির থেকেও বড়ো বড়ো পাথর ঠাসা পানির বালিশ।আর বালিশের সাথে ছলাৎ ছলাৎ পানির লাফিয়ে চলার ছন্দ মোক্ষম।আহ!কী নান্দনিক!কতো আরাম।কতো নয়নজোড়া মানিক।
দেশ ভেদে ভিন্ন মাত্রা হলেও প্রতিবেশি ভারতের সাথে ১৫০ গজ বা ৪৫০ ফুটের নোম্যান্সল্যান্ডের মাটি জুড়ে শরতের কাশফুল।কাঁটাতারের বেড় ঘেঁষে গরু মহিষের হাম্বা ধ্বনি।রাখালের হাতে বাঁশের কঞ্চি আর মাথাঘেরা ছায়ার আবহ।ভিসার তাগিদের না ছোঁয়া আক্ষেপের মেঘালয়। পাহাড়ের উপর সাদা সাদা তুলোর ফ্যাক্টরি। অবিশ্বাসের সীমানা কাঁটাতারের বেড় ঘেঁষা সবুজাব বৃক্ষ-তরু।মন মোহনীয় পলকী বাতাসের উদরে ডানা মেলা সাদা সাদা বকের সাথে অতিথি পাখির হামাগুড়িও এনে দিলো এক মায়াবী প্রশান্তি।আমরা রোদেলা প্রখরে পানির তরলে শরীর রাঙাতে নেমে পড়ি রাংপানি নদীর আরামে।যেখানে আমাদের শরীরের সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে খেলতে নামে পাহাড় থেকে নেমে আসা দূর সীমানার অতিথি অনন্য চ্যালামাছ।আমরা গামছা পাতি।আমরা খেলি।যেনো এক অন্যরকম আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় শরীর জুড়ে।শরীরে বিছানো প্রতিটি লোমের কূপে কূপে।তা-ই রাংপানি কে গলা ফাটিয়ে বলি;তৈরি থেকো-মাছ,
তরু গাছ।তৈরি থেকো-পাহাড়,কাঁশবন।তৈরি থেকো-পলি রাঙা কাঁদাজল।তৈরি থেকো-রাংপানি নদীর গতরে বালিশ পোতা লালে লাল পাথরের বালিশ আর জল খলবল ঢেউ।তৈরি থেকো-পাহাড়ের চূড়ামেঘ,পেঁজাতুলাের ফ্যাক্টরি।তৈরি থেকো- নোম্যান্সল্যান্ড আর সীমানা পিলার।তৈরি থেকো-রাখালের বাঁশি,আর বাড়ি ঘেঁষা গ্রামের ছোটো ছোটো মেঠোপথ।তৈরি থেকো-অভয় দেওয়া বা পথ চিনিয়ে দেওয়া গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম,জোছনা রায়।জলকাদা যুক্ত নৌকার সৌখিন মাঝি সাকিব আর অনিক,রথিন।আমরা আবারও আসবো তোমাদের বুকের অলিন্দে পোষিত ঢেউ মিতালির বাড়ি।এতোদিন যা ছিলে বুনোজঙ্গলে বা পাতাবাড়ির আড়ালে।আজ তোমায় মুক্তি দিতে সিলেট থেকে মাত্র ৫৪ মিনিটের পথ রাংপানি তে আসবে মানুষ।জৈন্তাপুর বাজার থেকে পেটের তাগিদ পুরন করে এসেই জেনে নেবে তুমি আছো ভারতের ঠিক সীমানার কাছাকাছি।মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে তোমার নিজস্ব বাড়ি।ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের রংহংকং থেকে ঢলে ছলে নিচে নামা পানিই পরিচয় দেবে তুমি ই আসলে রাংপানি।
লোকজন আসবে সিলেট থেকে শ্রীপুরে।শ্রীপুর থেকে পায়ে হেঁটে মাইলখানেক পথ মোকামপুঞ্জি।এবার সেখান থেকে ২০ ফুট নিচের দিকে নেমে গিয়ে নেমে পড়বে রাংপানির আনন্দ-উচ্ছল শরীরে।আসবে ক্যামেরা।আসবে মানুষ।সেলফির তোড়ে বাড় বাড়ন্ত হয়ে উঠবে রাংপানির জল।নিরাপদ হয়ে থাকবে পাহাড়ঘেরা সীমানা।সে ই আরও বেশি গদ্যময়।সেই রকম এক সুখদ কল্পনা রেখেই জল্পনার জন্য কপচে দিলাম রাংপানির লেখাখানি।
সম্পাদকঃ আব্দুল বাতিন ফয়সল
সহ-সম্পাদকঃ আব্দুল মুহিত দিদার
মোবাইলঃ ০১৭৩০১২২০৫১
sylhetexpress.net