আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্
রানি কে পাশ কাটিয়ে রাজার অস্তিত্ব যেমন ধারনাতীত।তেমনি,রাজা কে অস্বীকার করে রানির অস্থিত্বও থাকে না।শরৎ ঋতুর বেলায় সেই কথাটি যায়।কারণ বসন্তকে ঋতুর রাজা বললে শরৎকে তো রানি ই বলতে হয়।
আসে ভাদ্র ও আশ্বিন মাসকে নিয়ে।
বাংলাদেশের সবুজ মাঠ ঘেঁষে,নদীর কোল ঘেঁষে,ধানীজমিরআলে-আলে,বিল-ঝিল,
টিলা বা পুকুরের পাশ ঘেঁষে নরম কোমল স্নিগ্ধতা নিয়ে।
ঋতুবৈচিত্রের এমন পাগলপারা বাংলাদেশে ভাদ্র ও আশ্বিন মাসকে মিলিয়ে শরৎ বলা হলেও ইংলিশে শরৎকে'অটাম'বলে ডাকা হয়।
পৃথিবীর অধিক দেশে শীত, গ্রীষ্ম,বসন্ত কিংবা হেমন্ত এই ৪ টি ঋতুকে পাওয়া গেলেও শরৎকে অস্বীকার করে নয়।বাংলাদেশে তো বটেই।বাংলার আবহাওয়া আবার গ্রীষ্ম,বর্ষা,শরৎ,হেমন্ত,শীত ও বসন্ত নিয়ে ৬ ঋতুর গড়া।এ দেশের মতো একবছরে একসাথে ৬ টি ঋতুর এমন মিলনমেলা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না।
শরৎ ঋতু এমন এক ঋতু যে ঋতু প্রকৃতির কাছ থেকে আমাদের জন্য বারে বারে বহন করে আনে উৎসব আমেজের বার্তা।এ ঋতুকে নিয়ে কাঁশের ফুলে-ফুলে,ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিংবা নৌকার বাহনে করে মঙ্গলের বার্তা বয়ে আনেন দেবী দূর্গা।তিনি এলে-ঢাকের তালে-তালে জেগে ওঠে বাংলার পাড়া গা থেকে শহরের অলিগলি।শুরু হয় দেবী দূর্গার আরাধনা।চলে শারদীয় দূর্গোৎসব।আমরা তখন আদরে আপ্লুত হয়ে চেয়ে দেখি-প্রকৃতির কূলে-কূলে জেগে উঠেছে শরতের মৃদুমন্দ হাওয়া।ডানার মাপ ভুলে পাখিরা ঘুরে ঘুরে আসে যায় হাওয়ায়-
হাওয়ায়।রাতের ঘুমপাখি বে ভুলে বোল বোলে গাছেদের শাখায়-
শাখায়।ভোরের ফুটি-ফুটি আলোয় ফুলের সৌরভ নিতে নিতে,
আনমনা কোন প্রেমিক ঘাসের ডগা থেকে নিয়ে শিশিরের নাকফুল পরিয়ে দিতে চায়-জানালার শিকে দাঁড়ানো প্রেমিকার নাকের গরিমায়।শরৎ মাঝে- মাঝে ছোটো কোন সময় নিয়ে বৃষ্টি বিলিয়ে বিল-ঝিল কে করে তুলে মনমোহনীয়।তখন পুকুর,
ডোবা,হাওড়-বিলের স্বচ্ছ জলে হাওয়ায়-হাওয়ায় মাথা দোলানো শাপলাকে দেখে মনে হয়,এই বুঝি উৎসব মজলিসে হাসিতে পাগলপারা কোন লাজরাঙা প্রিয়তমা।
শরৎ ঋতু বর্ষা-বিদায়ী পলির উর্বরা মৃত্তিকা কে পুঁজি করে কাঁশফুলের বনে-বনে শাদা শাড়িতে সবুজ টিপ পরিয়ে আসে।
শরৎ এলে যেনো বারবার মনে পড়ে সে ই সুদূরে ফেলে আসা কোনো নবীনা প্রেমিকার কথা,যাকে নিয়ে কদমে কদম ফেলে দূর্বা ঘাসের নরম গালিচার চিকচিক করা শিশির বিন্দু দিয়ে কোন প্রেমিক পরিয়েছিলো নাকফুল।ঘাসের সমারোহে চিকচিক করা শিশিরবিন্দু নিয়ে ঝিরিঝিরি সকালের আলতো নরম হাওয়া কিংবা কিশোর-কিশোরীর পায়ের ছন্দতালের বৃষ্টিতে আকুল-
করা প্রেমময়তা পাশ কাটাতে পারে না কবি-সাহিত্যিকদের শিকারি চোখ।তারা প্রকৃতির এ প্রাণময়তাকে নিজস্ব কলম,তুলি নিয়ে শিকার করতে বসে যান।শিকার করেন প্রকৃতির রূপ অপরূপ দৃশ্য।চোখে চোখ ফেলে কেড়ে আনেন ঋতুর মায়া-
মমতা।সাহিত্য কে জাগিয়ে তুলেন শব্দভাষনে।শব্দে-শব্দে খাতার পাতাকে উর্বর করে তুলেন-কবিতা,গান,গল্প,উপন্যাস কিংবা তুলির আঁচড়ে দৃশ্যাবলী,প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছড়ালোক।তাই তো সেকালের চর্যাপদের পদকর্তা থেকে শুরু করে হাল আমলের কবির কবিতায়,লেখকের লেখায়,ঋতুরাণী শরৎও পেয়েছে প্রাধান্য।অতীতকালে যে কবির ঋতু নিয়ে ভীষণ মাতামাতি ছিলো সে ই মহাকবি কালিদাস কে শরৎ বন্দনায় দেখতে পাই-" প্রিয়তম আমার,ঐ চেয়ে দেখ,নববধুর ন্যায় সু সজ্জিত শরৎকাল সমাগত।"ঋতুসংহার কাব্যে লেখেন-" কাশফুলের মতো যার পরিধাণ,প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ,উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ,পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা,অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।"শরৎ যেমন বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছে তেমনি শরৎ বন্দনায় ডুবতে দেখেছি বাংলাসাহিত্যের আদি মধ্যযুগের কবি চন্ডীদাস কে ও।তিনি তাঁর কবিতায় লেখেন-"ভাদর মাঁসে অহোনিশি অন্ধকারে/ শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।/তাত না দেখিবোঁ যঁবে কান্হাঁঞির মুখ/চিনিতে মোর ফুটযায়িবে বুক"।
শরতে রাতের স্নিগ্ধতা আর কোমলতায় ঢেকে দেয় জোছনাময়ী মানুষের হৃদয়।এ সময় রাতের চাঁদ যেনো তার সর্বস্ব আলোয় ঢেকে দেয় পুরো ধরিত্রি।জোছনার আলোয় আলোয় বয়ে যায় শান্ত,সৌরভের বাতাস।দূর থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসে গাছে-গাছে সদ্যফোটা শিউলি ফুলের ঘ্রাণ।জোছনার সমধিক আলোয়-আলোয় পুলকে কর্কশ গলায় কাকেরা ও জানান দিয়ে দেয়-ভুল হয়েছে ভুলে।এমন মধুর রাতে কাক,পাখিদের ঠোঁটের শব্দে বোধহয় কবিরাও জেগে সাজিয়ে তুলতে চান বরণডালা-
"আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ,আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা/নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজায়ে এনেছি বরণডালা।"
শরৎ এলে যেমন সাথে আনে উৎসব তেমনি বিচ্ছেদ কেও মেনে নিতে হয়।
যেমন সনাতন মতবাদে প্রত্যক্ষ করি-
দশমীর বিচ্ছেদে মেয়ে উমাকে হারাতে গিয়ে মা মেনকা বলে ওঠেন-
"যেও না রজনী,আজি লয়ে তারা দলে।/ গেলে তুমি,দয়াময়ী,এ পরান যাবে।"
অন্যদিকে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে বাংলার ঋতু ধারনের সুনিপুন বাহক হিসেবে অন্তরে স্থান করে দিলে আমরা প্রত্যক্ষ করি-তিনি যেমন বাংলার ষড়ঋতুর সাথে বর্ষাকে পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের মন মন্দির থেকে বাংলার ঘরে-ঘরে।তেমনি শরৎ বন্দনার প্রতিটি পরতে-পরতে ছড়িয়ে দিয়েছেন মনোমুগ্ধতা-" শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেলো ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি/শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে/বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/আজ এ প্রভাতের হৃদয় ওঠে অঞ্চলি।/মানিক গাঁথা ওই যে তোমার কঙ্কনে/ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।/কুঞ্জ-ছায়া গুঞ্জরণের সঙ্গীতে/ওড়না ওড়ায় এ কী নাচের ভঙ্গিতে,/ শিউলি বনের বুকে যে ওঠে আন্দোলি।"তেমনি গোলাপ,বকুল,
মল্লিকা,কামিনী,মাধবী আর বিল-ঝিলে
মুখ তুলে তাকানো শাপলা আর নদীর তীর ঘেঁষে দোল খাওয়া কাঁশফুলের বাহারি দিগন্ত জুড়ে চিরসবুজ বাংলার ধানি মাঠ।মাঠে-মাঠে শ্যামশস্য হিল্লোলে আনন্দ গুঞ্জরন,গাছে-গাছে জেগে ওঠা পত্র-পল্লবে র সবুজ সমারোহ।অঙ্গনে-প্রাঙ্গণে শেফালির সৌরভ।গাছে-গাছে,ডালে বা পাতার আড়ালে দোয়েল,পাপিয়ার সুর তরঙ্গের খেলায় নিজেকে লুকানো দায় হয়ে পড়ে বলে কলমকে উজাড় করে সে ই রবীন্দ্রনাথকেই লিখতে দেখি-
"আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা,নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা,এসো গো শারদ লক্ষ্মী,তোমার শুভ্র মেঘের রথে,এসো মির্মল নীলপথে।"
বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে জানি-রনীন্দ্রনাথ শরৎ থেকে যেমন নিয়েছেন ভুরিভুরি তেমনি উজাড় করে দিয়েছেন বিভাভরি।বলেই হয়তো বিভার উচ্চারণ তাঁর কলম থেকে আরেকটু অন্যরকম ভাবে পাই-
"আজি শরতপতনে প্রভাত স্ব পনে/কী জানি পরান কী যে চায়!/ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে/বিহগবিহগী কী গায়!/আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে,/রহে না আবাসে মনে হয়!/কোন কুসুমের আশে কোন ফুলবাসে/সুনীল আকাশে মন ধায়!/আজি কে যেন গো নাই,এ প্রভাতে তাই/জীবন বিফল হয় গো!/তাই চারিদিকে চায়,মন কেঁদে গায়/ 'এ নহে, এ নহে,নয় গো।"
তাছাড়া বাংলার আকাশকে সমুজ্জল করে বাংলা সাহিত্যকে নতুন মাত্রাদানের জন্য যার অবধান অতিস্মরণীয়।তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।শরৎ বন্দনাকে একান্ত নিজস্ব শৈলীতে আগুয়ান করে শরতের বাহারি ফুল-হিমঝুরি,গগনশিরীষ,ছাতিমপাখি,
পাখিফুল,পান্থপাদপ,বকফুল,মিনজিরি,
কলিয়েন্ড্রা ফুলের মুগ্ধতা ছড়িয়ে বলেছেন-
"সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশে ধরণী/নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী/অলকার পানে বলকা ছুটিছে মেঘদুত মনমোহিয়া/চঞ্চু রাঙা কলমীর কুড়ি মরতের ভেট বহিয়া/সখীর পায়ে সেউতি বোটার ফিরোজায় রেঙে পেশোয়াজ/আসমানি আর মৃন্ময়ী মুখি মিশিয়াছে মেঠোপথ মাজ।" অন্যদিকে শরৎ এ ফোটা শিউলিফুলে আকুলিত মনে বিপুল বিন্যাসে ডাকেন-"এসো শরত প্রাতের পথিক/এসো শিউলি বিছানো পথে/এসো বুইয়াচরণ শিশিরে/এসো অরুণকিরণ রথে/দলি শাপলা শালুক শতদলে/এসো রাঙায়ে তোমার পদতলে।"কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানে,গুনে সারা বাংলা কতোটুকু সঞ্চারিত,গানের জলসাতেই তার চিত্র পাওয়া যায়-"
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে,নয়নে বারি ঝরে…/
ঝরিবে পূবালী বায় গহন দূর বনে/রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে/বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নীপ-শাখে/যমুনা নদী পাড়ে শুনিবে কে যেন ডাকে/বিজলী দীপ-শিখা খুঁজিবে তোমায়,প্রিয়া/দুহাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে/বাহিরে ঝড় বহে,নয়নে বারি ঝরে…"
শরৎ এলে বিকেলের সোনারোদ ঝলমলে হাসি আর সন্ধ্যার শান্ত আবছা শিশিরে মন উড়ে যায় অজানায়।নদীর ধারের মৃদু মৃদু বাতাস কাশফুলের শুভ্রতায় যেনো অনুপম করে তুলে পল্লীপ্রকৃতি।তাই হয়তো আজীবন শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ কে শরৎ বন্দনায়ও পাই-
"এখানে আকাশ নীল নীলাভ/আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল/ফুটে থাকে হিম সাদা রং তার/আশ্বিনের আলোর মতো/আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এখানে করে গুঞ্জরণ/রৌদ্রের দুপুর ভরে কারবার/রোদ তার সুচিক্কণ চুন/পড়ে পড়ে বারবার রোদ তার সুচিক্কন চুন/কাঁঠাল,জামের বুকে নিংড়ায়/দহে বিলে চঞ্চল আংগুল।"
শরতের মাঠে মাঠে কৃষকেরা যখন ধানের নেশায় ধানিজমিতে নেমে আনন্দ কুড়ায় তখন বুঝে নিতে হয় এসে গেছে নবান্ন।নবীন চালের রাজত্বে কৃষকের ঘর।উদ্বেল আনন্দে জেগে উঠবে বাংলা।পিঠা হবে,পায়েশ হবে।তালের রসে হবে রসে জবজব পিঠা।কেনো না শরতের অন্যরূপের আরক নাম ই তো নবান্ন।কৃষাণ-কৃষাণি অতিথি হলে অন্যেরা অতিথি ই তো তার নিজ ঘরে।তাই স্বয়ং রবিঠাকুরকে এ দৃশ্যের ও দৃশ্যায়ন করতে দেখি,
তাঁর কবিতায়।তিনি লেখেন-"আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা।"
আবার অন্য কোনোখানে,আরেক কবিতায় বলেন-" শরতে আজ কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে/আনন্দ গান গা রে হৃদয়, আনন্দ গান গা রে।/নীল আকাশের নীরব কথা শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা/বেজে উঠুক আজি তোমার বীণার তারে তারে/ শস্যক্ষেতের সোনার গানে যোগ দে রে আজ সমান তালে,/ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অমল জলধারা।"
শরৎ এমন এক ঋতু যে ঋতু রাণী হয়ে এলে ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃতি যেনো প্রাণের মাত্রা বাড়িয়ে আনে।প্রকৃতি তার আপন মহিমায় ফিরে পায় নতুনের এক আবহমান মাত্রা।তখন সকাল,
বিকেল সন্ধ্যা রাতের শরীরে জাগে অচেনা স্পর্শের দোলদোলা।আর সে স্পর্শেও জেগে ওঠেন আমাদের নাগরিক কবি শামসুর রাহমান।তিনিও আশ্রয় ফিরে পান কবিতার ছত্র ছায়ায়- "জেনেছি কাকে চাই,কে এলে চোখে ফোটে/নিমিষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা।"
শরতের কালে নদীর কিনারে।পুকুর,জলাশয়,বিল-ঝিলের ধারে কাছে ফোঁটা কাঁশফুলে কবি নির্মলেন্দু গুণ ততোই মুগ্ধতা ছড়ান।তাঁর কবিতার চলে আসে মুগ্ধ কবিতার রূপ-" সবে তো এই বর্ষা গেল/শরৎ এলো মাত্র,/এরই মধ্যে শুভ্র কাঁ/ভরলো তোমার গাত্র/ক্ষেতের আলে মুখ নামিয়ে/পুকুরের ঐ পাড়টায়/হঠাৎ দেখি কাঁশ ফুটেছে/বাঁশবনের ঐ ধারটায়/ আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে/ মাটির দিকে নুয়ে/দেখি ভোরের বাতাসে কাঁশ/দুলছে মাটি ছুঁয়ে।/পুচ্ছ তোলা পাখির মতো/ কাঁশবনে এক কন্যে,/তুলেছে কাঁশের ময়ূর চূড়া/কালো খোঁপার জন্যে।"
কবি আল মাহমুদ লেখেন-"বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে শরতের উদারতা,মেঘ ভেসে যায় মাথার ওপরে বৃষ্টির ছোঁয়া দিয়ে ভেতরে বসে থাকি সারাদিন কিন্তু বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা টান লাগে সারা বুকে মনে হয় যেন আমার বুকে কান পেতে আছে কেউ আজ সারাদিন হাওয়ার মাতম বইছে বাধন ছিড়ে" আবার শরৎ কবিতা লেখেন-"এক শরতে বিদায় হলে আমার থেকে কিছু ছন্দ কিছু গন্ধ গেছ আজও সে সব স্মৃতি আমার পড়ছে মনে হাওয়ায় যেন ভাসছে হৃদয় আপন মনে।ভাসছে হৃদয় কাঁশের ফুলে ঘাস যেখানে ঘন হয়ে ছড়িয়ে আছে। কুঞ্জবনে আসছে শরৎ আবার দেখো ভাসছে।হৃদয় হাসছে একা কাঁশের ফুলে সংগোপনে।"মনের রাজ্যে শরতের আবাহন ক্লান্তি হরা জীবনকে কাছে টানতেই বোধ হয় কবি আহসান হাবীব তাঁর শরৎ কবিতায় লেখেন-" এবারের শরত রাত্রি স্বপ্ন এনেছে সঙিন লুণ্ঠিত স্বর্ণের শীষে সে স্বপ্ন রঙিন কেঁদে মরে মৃত্তিকায় মিশে যায় ধীরে এবার শরৎ রাত্রি উদযাপিত হবে আঁখি নীরে।"
কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ কেও শরৎ বন্দনায় বলতে শুনি-"ঘন কালো মেঘের আঁধার একটু হাসে একটু কাঁদে রোদের সাথে লুকোচুরি খেলাটা বেশ জমিয়ে তোলে এই যে এখন মনটা ভালো এই যে এখন মনটা খারাপ ইচ্ছে হলেই গাল ফুলিয়ে কান্না শুরু ইচ্ছে হলেই রোদের পরে রোদের খেলা কখন কী হয় সবাই ভীতু এমন যে শরৎ ঋতু।"
শরৎ যে একটা ঋতু-শুধু তা নয়।শরৎ প্রকৃতির রাণী।আর রাণীকে ঘিরে মাতামাতিতেও মাতেন কবি হাসান হাফিজ।তাঁর কথায়-"শরতে জন্মেছি চাই শরতেই হোক ছুটি। আলগোছে নিভৃত প্রস্থান।শরত মানব মনে সঞ্চারিত করো তুমি কিঞ্চিত দয়া ও ধর্ম, পয়দা করো হৃদয়ে রহম তারা যেন ভালোবেসে নিষ্কলংক শিউলিফুল সামান্য দরদী হয়।মানবিক হয়।শরৎ হে বঞ্চিতা ঋতু সামান্য কবির এই অনুল্লেখ্য গরিবি আরজ।অবহেলে দিয়ো না ফেলে করুনা বশত করো প্রীতি বিবেচনা।"অন্যদিকে দেশের বিখ্যাত তুলি শিল্পী,মোস্তফা মনোয়ার।তিনি বলেন-"শরৎ যে এত সুন্দর আগে হয়ত বাঙালি জানতোও না।রবীন্দ্রনাথই তাঁর গান,কবিতার মাধ্যমে সবাইকে শরৎকাল উপভোগ করতে শিখিয়েছেন।তাঁর গানগুলো শুনলেই শরতের সমস্ত সৌন্দর্য ধরা পড়ে।…গ্রামের বধূ যেমন মাটি লেপন করে নিজ গৃহকে নিপুন করে তোলে,তেমনি শরৎকাল প্রকৃতি কে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়।বর্ষার পরে গাছগুলো সজীব হয়ে ওঠে।আকাশে হালকা মেঘগুলো উড়ে উড়ে যায়।"
বাংলার হৃদাসন জুড়ে প্রতিবছর শরতের অবস্থান হলেও আমরা ঝিলে ফোঁটা দেখি।গায়ে মাখি প্রভাতের হাওয়া।কাঁশের বনে বনে পুলকে পুঞ্জিভুত করি মন।প্রিয়ার চকিত চাহনি মাখি হৃদয়ের গহীন বন্দরে।কিন্তু এ ও দেখি,জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে কেমন জানি অচেনা লাগে ঋতুরাণী শরতের রূপ।তাছাড়া সময়ের দুঃসময়ে মোবাইল জীবনধারণে আমরাও কেমন জানি বদলে যেতে চলেছি।উৎসব আছে, নবান্ন নেই।মাঠের গালিচায় লেপে দেওয়া ইট-পাথরের ঢালাইয়ে দেখা হয় না আর ঘাসের উপর জল চিকচিক শিশির বিন্দু। মরা নদী,মরা খাল,মরা পুকুরে পাওয়া যায় না কাঁশফুলের নরম ছোঁয়া।সারি সারি সারসের নীবিড় উড়াউড়ি।এখন আমরা নিজের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে পোষি।প্রকৃতির অকাতরে দান আমরা চাই না।মোবাইলের বাটন টিপে শরৎ ঋতু দেখি।গায়ের পথে পথে শরীরে শিশির মেখে আজকাল আর শরৎ দেখি না।অথচ বছর ফি বছর শরৎ এসে বাংলার জানালায় নরম রোদের ঝিলিক দিয়ে যায়।আকাশে এখনও ওড়ে ঘনঘন পেঁজাতুলোর পাখনা মেলা ডানা পাখি।এটুকু দেখার সময় মেলে না আমাদের।তবুও চাই,বাংলার হৃদয়জুড়ে শরৎ আসুক শরৎ এর রানীকে নিয়ে।কেনো না শরৎ এলে কিছুতো একটা হয়।জাগতে পারেন কবি-সাহিত্যিক।জাগতে পারে শিল্পীর গানের গলা।
সম্পাদকঃ আব্দুল বাতিন ফয়সল
সহ-সম্পাদকঃ আব্দুল মুহিত দিদার
মোবাইলঃ ০১৭৩০১২২০৫১
sylhetexpress.net