সুলেমান কবির :
মোহাম্মদ বিলাল একজন জাত শিক্ষক। তবে তাঁর আরেকটা বড় পরিচয় তিনি একজন কবি- আগুনপাথরের কবি।আগুনে পুড়ে সোনা যেমন আরও খাঁটি হয় মোহাম্মদ বিলালও তেমন বেদনার অনলে পুড়ে হয়েছেন আগুনপাথরের কবি- আমাদের কবি। তাঁর কবিতায় পাই- "কোনও দিন সাহস করে বলিনি আমার হৃদয় কতটা বিদগ্ধ, প্রেমে ও ঘৃণায় কতটা আগুনপাথর।" (আগুনপাথর,পৃষ্ঠা-৩৫) অথবা "একটা ছাইদানি দিন মাননীয় মেয়র, আমার হৃদয়টাকে রেখে ঘুমুতে যাব।" ( ছাইদানি,পৃষ্ঠা-৫১) তবে কবিমন প্রেম ও ঘৃণায় বেদনার্ত হলেও পরাজিত নন,বালির বাঁধের মতো ভেঙ্গে পড়তে রাজি নন তিনি। তাঁর দৃপ্ত উচ্চারণ- "এখন সেখানে আর জারুল গাছটি নেই, আছে অন্য এক উদ্ভিন্ন জারুলতরুণী- সর্বাঙ্গে সবুজপাতা আর গোলাপি ফুলের বাহার আমি প্রতিদিন তার শরীর চুইয়ে পড়া জল পান করি।" (আমি বেঁচে যেতে চাই,পৃষ্ঠা-২৩) একজন কবি মূলত কালের রাখাল- সময়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।মোহাম্মদ বিলালও তাই। ফলে এই সময়ের শিক্ষার্থীরা বই পড়ার প্রতি যে উদাসীন এবং তাদের যে ভোগবাদী জীবনের প্রতি প্রবল আগ্রহ তাঁর সচেতন চোখ এড়িয়ে যায় নি। তাঁর 'আয়নার সামনে:দুই' কবিতা পাঠ করলে অন্তত আমরা তাই দেখতে পাই। কবি মোহাম্মদ বিলালের জীবনের বড় একটা সময় শহরে কাটলেও তাঁর নাড়ী জকিগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামে পুতা।চাকরির সুবাধে শহরের বাস্তবতায় দিনাতিপাত করলেও মনন ও চিন্তায় তিনি শতভাগই গ্রামের- নগরকান্দি গ্রামের।তাই তো কবি সুন্দর করে বলে উঠলেন- "ধরো,গ্রামের মানুষ এক আমি- শহুরে বিপণিবিতানে বিশ্বাস নেই কোনও, তাই কলাপাতায় রেখে দেই ভালোবাসা।" (অমৃতস্য হই,পৃষ্ঠা-২২) শেকড় যে ভুলে যায়,জন্মনদী জন্মভিঠা ভুলে যায় যে সহজে!শহরের লেভাস যে ধরে নেয় প্রথম প্রেমের মতো সে আর যাই হোক মানুষ হতে পারে না। কবি মোহাম্মদ বিলাল এখানে ব্যতিক্রম। তিনি বলেন- ''মাঝে মাঝে আমি বাড়ি যাই, মা-বাবা আছেন, আমাকে দেখে হাসেন, পাকা কলার কাদির মতো তাঁদের দাঁতগুলো সোনা ছড়ায় যেন বাড়ি ভরতি সোনা, মাটি ভরতি সোনা।" (বাতাস আমার জীবন,পৃষ্ঠা-২৯) কবিরা শব্দের বেসাতি করেন। মোহাম্মদ বিলাল শব্দ চয়নে যেনো অনেকটাই গ্রামের। আরেকটু বাড়িয়ে বললে বলা যায় শব্দকে প্যাচিয়ে ভারী করতে রাজী নন তিনি বরং তিনি যা দেখেছেন তাই যেনো সুন্দর করে বলতে চাচ্ছেন আমাদের ;অথচ পড়তে গেলে যেনো ঘোর কাটে না। "মানুষের গু-মুতে ভরা পথ পার হয়ে মানুষের কাছেই যাব তোমার লণ্ঠনের আলোটা দাও।" (লণ্ঠনটাকে তুলে ধরো বাজান) কবি মোহাম্মদ বিলাল মূলত প্রেমের কবি। তবে তাঁর 'আগুনপাথর' বইয়ের বেশ কয়েকটি কবিতা সচেতন ভাবে পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই যে তিনি দ্রোহ ও বিপ্লবের সুযোগ্য উত্তরাধিকার।তিনি কেবল এখানে কালি ও খাতা নষ্ট করতে আসেন নি;লেখার জগতে তাঁর দায় আছে।তিনি রাষ্ট্র-সংঘ ভেঙ্গে দিয়ে মিলিত হতে চান রাষ্ট্রহীন জীবনে। তাঁর 'বিকেল','লোকটাকে কেউ ভালোবাসেনি', 'কামারশালা আমার সহোদর' 'মহাশয় ও হাভাতে কুকুর' 'মহাজনেরা এবার চুপ হবে','সময়ের ওপারে' প্রভৃতি কবিতাগুলো অন্তত তাই বলে। কবি মোহাম্মদ বিলাল একজন শিক্ষক। বর্তমান বাস্তবতায় একজন শিক্ষক কতটা কষ্টে বাঁচেন,কতটা নিরবে সহ্য করে যান বেদনার পাহাড় তা তিনি এরিয়ে যেতে পারেন নি। তাঁর ভাষায়- 'শিশুদের বলাৎকার গণধর্ষণ অথবা গুম-খুন এসবে আমাদের দায়িত্ব নেই এসব দেখে আলাদা লোক! মন দিয়ে শুনুন আমরা মাস শেষে মাইনে পাই কোনও ঝামেলা পছন্দ করি না। (মহাশয় ও হাভাতে কুকুর,পৃষ্ঠা-৩৭) 'আগুনপাথর' কবিতাবইটি প্রকাশ করেছে 'নাগরী'। কবিতাবইটির প্রায় সবগুলো কবিতাই চমৎকার, তবে বইয়ের বেশ কয়েকটি কবিতায় মনে হয়েছে লেখক তারাহুরো করে লিখেছেন বা পর্যাপ্ত সময় পান নি।তাঁর 'আজকাল' ও 'শিতালং শাহ' কবিতাগুলো অন্তত তাই বলে। 'শোভন সকাল','ঘাম আর অন্ধকারে' কবিতাগুলো আপাত দৃষ্টিতে জীবনানন্দের প্রভাব স্বীকার করলেও তাঁর বেশিরভাগ কবিতা একটা নিজস্ব রোড নির্মাণ করতে পেরেছে তা বলাই যায়। 'আগুনপাথর' পৌঁছে যাক হাতে হাতে পাঠকের হৃদয়ে।
লেখক: সুলেমান কবির কবি ও শিক্ষক
সম্পাদকঃ আব্দুল বাতিন ফয়সল
সহ-সম্পাদকঃ আব্দুল মুহিত দিদার
মোবাইলঃ ০১৭৩০১২২০৫১
sylhetexpress.net