
হোসাইন আহমদ সুজাদ :
একসময় বিশ্বাস ছিল—সত্য, সততা, পরিশ্রম আর মেধা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যিনি নীতিনিষ্ঠ, যিনি তথ্যভিত্তিক কথা বলেন, তিনিই সমাজে আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হতেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সে বিশ্বাস আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এখন মনে হয়, সত্য নয়—চালাক মিথ্যাই যেন হয়ে উঠেছে এই সমাজে সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।
আজকের বাস্তবতায় চোখ ফেরালে দেখা যায়, যাঁরা সবচেয়ে বেশি প্রচারিত, আলোচিত কিংবা ‘সফল’ হিসেবে পরিচিত, তাঁদের সিংহভাগের গল্পের ভিত্তি গড়া কৃত্রিমতায়, মোহে, আর পরিকল্পিত নাটকীয়তায়। ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব ভিডিও, ইন্সটাগ্রামে ফিল্টার লাগানো জীবন—সব মিলে গড়ে উঠছে এক মুখোশধারী সমাজ। এই সমাজে সত্য বলাটা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ আর মিথ্যা বলা একধরনের ‘আর্ট’।
একজন প্রকৃত পরিশ্রমী হয়তো দিনের পর দিন মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন, নিজের মেধা ও সততা দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছেন—কিন্তু তিনি লাইমলাইটে নেই। আর অন্যদিকে একজন, যিনি মিথ্যা সাফল্যের গল্প বানিয়ে, নিজেকে ‘আলোকিত মানুষ’ সাজিয়ে প্রতিনিয়ত প্রচার চালাচ্ছেন, তিনি সমাজে একজন ‘রোল মডেল’। তাকে নিয়ে আলোচনা হয়, তাকে সম্মাননা দেওয়া হয়, তাকে অনুসরণ করার জন্য বলা হয়।
শিক্ষা, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, এমনকি সমাজসেবার মতো খাতগুলোতেও এখন প্রচারের আলো ছাড়া সৎ অবস্থান গড়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন পরিশ্রমী আদর্শবান নেতা পেছনে পড়ে থাকেন, আর একজন নাটুকে বক্তা শুধু ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হয়ে যান ‘জনদরদী নেতা’।
কেন এই পরিবর্তন?
এর অন্যতম কারণ আমাদের বিচারবোধের অবক্ষয়। আমরা এখন সত্য যাচাইয়ের চেয়ে চটকদার শিরোনাম বা ভাইরাল ভিডিও দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। আমরা চোখ ধাঁধানো প্রেজেন্টেশন দেখি, কিন্তু ভিতরে কি আছে—তা যাচাই করি না। শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও ঢুকে গেছে এই ফাঁপা সাফল্যের সংস্কৃতি। ‘কে কত নম্বর পেল’ বা ‘কার সার্টিফিকেট বেশি চকচকে’, তা নিয়ে মাতামাতি হলেও কে সত্যিকার অর্থে দক্ষ, তা নিয়ে চিন্তা করার মানসিকতা কমে গেছে।
মিথ্যার এই উল্লাসের সবচেয়ে বড় শিকার—সত্য।
আজ সত্যবাদীরা কোণঠাসা। তাঁদের অনেকে চাকরি পাচ্ছেন না, অনেকে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, অনেকে ভাঙছেন মানসিকভাবে। কারণ তাঁরা আপোস করতে জানেন না, তাঁরা ‘চালাকি’ শিখেননি, তাঁরা সত্য বলেন—যা এই সমাজ আর শুনতে চায় না।
সমাধান কোথায়?
সমাধান কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শেখাতে হবে যে সাফল্য মানেই ভাইরাল হওয়া নয়—সাফল্য হলো নিষ্ঠা, দক্ষতা, আর মানুষের উপকার করার ক্ষমতা অর্জন করা। সাংবাদিকদের দায়িত্ব সত্য তুলে ধরা, আলোচনায় আনতে হবে পর্দার আড়ালের পরিশ্রমীদের।
নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে লোকদেখানো বক্তা নয়, কাজের মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে। আর আমাদের প্রত্যেককেই প্রশ্ন করতে হবে—আমি কী বিশ্বাস করব? যে চটকদার ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে, নাকি যে মানুষটি বছরের পর বছর নীরবে ভালো কাজ করে যাচ্ছে?
যদি সমাজের নিয়ন্ত্রক চাবিকাঠি মিথ্যার হাতে তুলে দিই, তাহলে একদিন সত্য আর ফিরে আসবে না। তখন শুধু আমরা নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও পথ হারাবে। সুতরাং, আজই আমাদের ঠিক করতে হবে—আমরা কী সত্যকে জায়গা দেব, নাকি মিথ্যার মুখোশে মোহগ্রস্ত থাকব?
– হোসাইন আহমদ সুজাদ
রিপোর্টার, একাত্তর টেলিভিশন
T