
সায়েম চৌধুরী: সিরাজুল হক। নব্বই দশকের মধ্যভাগ থেকে তাঁর সাথে চেনাজানা। কেমুসাস এর নিয়মিত সাহিত্য আসরের অতি পরিচিত মুখ। বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায় ঝড় বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ অথবা প্রচণ্ড গরমকে বগলদাবা করে ছুটে আসতেন আসরে। বুক পকেটে ময়লা কাগজে ‘ইজেল’ নামে দীর্ঘ এক ধারাবাহিক উপন্যাসের সদ্য লেখা পর্ব। ঐ সময়ে স্টার প্লাস চ্যানেলে কিউ কি সাস কাভি বহুতি নামের একটা সিরিজ নাটক হচ্ছিল, ঐ নাটকের যেমন কূল নাই, কিনার নাই, শেষ নাই তেমনি সিরাজুল হকের ‘ইজেল’ উপন্যাসেরও ইতি ঘটে না। আমরা বলি, ও সিরাজ ভাই ইজেলের ডিজেল কি ফুরোয় না! আর কত দূর যাবে?
সিরাজুল হক হাসতেন খুব কম। মনে হতো তীব্র মাথাব্যথার কারণে মুখ গোমড়া। আমাদের রসিকতায়ও তাই তাঁর মুখে হাসি দেখি না। দিনে দিনে সম্পর্ক কিছুটা পোক্ত হলে জানতে পারি, মাথা ব্যথা নয়, মাথার ওপর প্রচণ্ড চাপ তাঁকে হাসিখুশির জগত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।
সিরাজুল হক কথা বলতেন খুব কম। নিজের একান্ত কথা বলতে আরও বেশি আপত্তি। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যত দূর জানি, একটা ব্যাংকে চাকরি করতেন তিনি। কোনো একটা কারণে চাকরিটা চলে গেছে। সিরাজুল হকের বদ্ধমূল ধারণা, অন্যায়ভাবে তাঁকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ঐ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হোন।
সিরাজুল হকের ‘ইজেল’ উপন্যাসের যেমন শেষ হয় না তেমনি আইনি লড়াইয়েরও ইতি ঘটে না। বছরের পর বছর যায়। ইজেল এবং আদালত এই বৃত্তে আটকা পড়েন তিনি।
বৃহস্পতিবারের সাহিত্য আসরে নিয়মিত ইজেল পাঠ করেন তিনি, আমরা সেটা শুনি কি-না তাতে যেনো তাঁর বিন্দুমাত্র কিছু যায় আসে না। সপ্তাহের অন্যদিনগুলো তিনি একই রকম ভাবে হয়তো মামলার পেছনে লেগে থাকেন, কত বছর যে কোর্টে ধর্ণা দিতে হবে, সিরাজুল হককে সেটা নিয়েও বিচলিত হতে দেখি না। তিনি কেবল লড়াইটাকেই বড় করে দেখেছেন। জানতেন, লড়ছেন। এটাই ছিলো তাঁর সান্ত্বনা।
আজ বুঝি, সিরাজুল হক ছিলেন ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি। স্কটিশ রাজা রবার্ট ব্রুসের মতো ছিলো তাঁর অসীম ধৈর্যশক্তি। সেই রবার্ট ব্রুস, ছয় ছয় বার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মাকড়সার জাল বুনতে যাওয়ার চেষ্টা দেখে যিনি বুঝতে পারেন, যতক্ষণ শ্বাস, ঠিক ততক্ষণ আশ। লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই।
রবার্ট ব্রুস সপ্তমবারের চেষ্টায় যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন।
সিরাজুল হক ভাই কি শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন? জানি না। বহু বছর তাঁকে দেখি না। বহু দিনের দূরত্ব। আর আজ জানলাম, তিনি নেই। পাড়ি দিয়েছেন চির ঘুমের দেশে।
সিরাজ ভাই, আপনার দীর্ঘ ইজেল উপন্যাসে সেই তারুণ্যে আমাদের ছিলো একরাশ অবজ্ঞা। লেখাটিকে ক্লান্তিকর ভেবে আমরা চোখ, কান ফিরিয়ে নিয়েছিলাম…।
আজ বুঝতে পাই, ওঠা ছিলো আপনার সাধনা। প্রকৃত সাহিত্য সাধনা।
‘ইজেল’ কখনো শেষ হয় না, কারণ প্রতি রাতে ইজেল লিখে আপনি জমা করতেন আগামীকালের লড়াই করার রসদ।
এমন লড়াকু লেখকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
জীবনে আপনি হেসেছেন বেশ অল্প, পেয়েছেন খুব কম সুসংবাদ। প্রার্থনা করি, পরকালে মহান স্রষ্টা আপনাকে চিরকালীন আনন্দে থাকার সুসংবাদ দিন।