সেক্সপিয়ারের দেশে’এর কড়চা


পুলিন রায় :
“স্ট্রাটফোর্ড শহরের ওপর দিয়ে লম্বা আঁকাবাঁকা হয়ে আভন ক্যানেলটি ফিতের মতো শুয়ে আছে। ক্যানেলের সাফসফা জলের রেখাটিকে মনে হয় কোনো নারী তার জলের গতর বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছে।”– লেখক মোয়াজ আফসারের “শেক্সপিয়ারের দেশে” বইটি পাঠের সময় এরকম অসংখ্য বর্ণনা মন ছুঁয়ে যায়। মনে হয় গদ্য নয় কবিতা পড়ছি। পড়তে পড়তে অসাধারণ ছবির মতো অদেখা-অচেনা জায়গার নান্দনিক চিত্রকল্প ভেসে উঠে মানসদর্পণে।
‘শেক্সপিয়ারের দেশে’ বইটি এক ধরনের সাহিত্যিক ভ্রমণকাহিনি। ঝকঝকে উন্নতমানের রঙিন কাগজের ছাপায় এটি বের হয়েছে ১ জানুয়ারি ২০২৪-এ, কৈতর প্রকাশন সিলেট থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন লুৎফুর রহমান তোফায়েল। লেখক মোয়াজ আফসার বৃটেনে অবস্থানকালিন তাঁর ব্যক্তিগত বিচিত্র অভিজ্ঞতা কাব্যময় বর্ণনাশৈলিতে বইটিতে তুলে ধরেছেন। মোট ১৭ টি স্মৃতিগদ্য এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। নিবন্ধ বা প্রবন্ধের কাঠামোতে প্রতিটি স্মৃতিগদ্য সুখপাঠ্য। এগুলো পাঠান্তে পাঠকের মনে হবে যে, পাঠকও লেখকের সাথে সাথে বৃটেনের বা লন্ডনের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানসহ শেক্সপিয়রের স্মৃতিজড়িত জায়গাসমূহে ভ্রমণ করছেন। যেটা ঘটেছে আমার ক্ষেত্রেও।
‘শেক্সপিয়ারের দেশে’ বইটিতে ১৭ টি অধ্যায়ে বিভক্ত স্মৃতিগদ্যের নামগুলোও চমৎকার। অধ্যায়গুলোর নামকরণে লেখকের চিন্তার বিষয়বৈচিত্র্যের চমৎকারিত্ব লক্ষ্যনীয়। ১৭টি অধ্যায়ের নামগুলো হচ্ছে (১) গাঙচিলের বাসর স্বপ্ন, (২) শেক্সপিয়ারের ডেরায়, (৩) লন্ডনের ফুটপাতে বসতি, (৪) ব্রিটিশরাজে একরত্তি বাংলাদেশ, (৫) এক প্রিন্সেসের হারিয়ে যাওয়া, (৬) এবং একটি লিফলেট, (৭) ঘোড়ায় চড়িলেন গোডিভা, (৮) হোয়াইট ক্রিসমাস, (৯) হরে কৃষ্ণ হরে রাম, (১০) অক্সফোর্ড ও মরোক্কান রেস্তোরাঁ, (১১) ‘দ্য পিপিন’ পাব-এ মাতাল এক রাত্তি, (১২) ইংলিশ মায়ের সিলেটি পুত, (১৩) অঞ্জলি লহ মোর, (১৪) ডানাভাঙা পরী, (১৫) এক নিশি এক স্টেশন, (১৬) মোমের পুতুল মোমের দেশে এবং (১৭) এই ছিলো তাহার মনে।
শিরোনামগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক ও আকর্ষণীয়। লেখক মোয়াজ আফসার সিলেটের মানুষ। তিনি সমাজ সচেতন বিদগ্ধ একজন লেখক। তাঁর চিন্তাচেতনায় প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার রঙ-রূপ ও সিলেটি মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন বিষয় সতত বিরাজমান। এটা তাঁর লেখায় আসাটা খুবই স্বাভাবিক। এবং এসেছেও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যঞ্জনায়। ‘লন্ডনের ফুটপাতে বসতি’, ‘ব্রিটিশরাজে একরত্তি বাংলাদেশ’, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’, ‘ইংলিশ মায়ের সিলেটি পুত’ এবং ‘অঞ্জলি লহ মোর’ প্রভৃতি অধ্যায়গুলো পড়তে পড়তে পাঠকের হৃদয়ে খেলে যাবে অন্যরকম আনন্দ-বেদনার অবিমিশ্র অনুভূতি–যা ব্যাখ্যার অতীত। বইয়ের পরতে পরতে যেমন আনন্দের বর্ণনা আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশি বিশেষ করে সিলেটিদের সংগ্রামের ইতিবৃত্তও।
‘শেক্সপিয়ারের দেশে’ মোয়াজ আফসারের এক অনন্য গ্রন্থ। এটি পাঠান্তে ভালো লাগার এক মধুরিমায় মন ভরে যাবেই যাবে।
বইটি সম্পর্কে লেখক বলেন, ”এর পরের দিনগুলোতে শুরু হয়… স্বপ্ন জুড়ার গল্প। জীবনের প্রয়োজনে কখনো স্বল্প কখনো দীর্ঘ হয়েছে ব্রিটেনে বসবাস। এই সময় প্রবাহে যা আমার চোখে ধরেছে তার খণ্ড খণ্ড চিত্র ১২৮ পৃষ্ঠার এই জমিনে আঁকার চেষ্টা করেছি।… বইয়ের এ তরী নোঙ্গর করতে খরচ করেছি দুই যুগেরও বেশি সময়।” এতে করে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না বেশ কোমর বেধেই লেখক নেমেছিলেন লেখার যুদ্ধে। এবং তিনি সফল হয়েছেন। যদিও তাঁর খেদোক্তি, ‘তবু হৃদয়ে বাজে, মোর না মিটিতে আশা ভাঙ্গিল খেলা।’ এটা লেখকের বিনয় হতে পারে। তবে প্রতিটি কবি-লেখক মনে করেন তিনি আসল লেখাটি এখনো লিখতে পারেন নি। লেখকের এই অতৃপ্তি আশা জাগানিয়া।
বইটি সম্পর্কে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার প্রাপ্ত বিশিষ্ট ভ্রমণলেখক শাকুর মজিদ যথার্থই বলেছেন, ” ‘শেক্সপিয়ারের দেশে’ নামক একটি বই লিখেছেন মোয়াজ আফসার। বইটি প্রকাশের আগে আগে এর একটা পিডিএফ কপি এসেছে, এবং মনোযোগ দিয়ে বইটির ১৭টি অধ্যায়ের প্রায় প্রতিটি পড়ে ফেলি। …বিলেতে অবস্থানকালে তাঁর স্মৃতিকথার যে রূপ বইটিতে আমি পেয়েছি, আমি তাতেই মুগ্ধ।”
লেখক মোয়াজ আফসার একজন স্বপ্নবান মানুষ। তাঁর কিশোরকাল থেকেই তিনি শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি দারুণভাবে টান ছিলো। বইয়ের ফ্ল্যাপে সংযুক্ত গল্পকার সেলিম আউয়ালের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি,”মোয়াজ আফসার, স্কুলের গণ্ডি তখনো পার হননি, কিন্তু রীতিমতো সেলিব্রেটি। আমাদের শহরের প্রথম ব্যান্ড দল ‘জাগরণী’ পপ দল’র মুখ্য শিল্পীদের একজন তিনি। শহরে তো আছেই, দূরদূরান্তেও আমন্ত্রণে যেতে হয়–খামছে ধরা জিন্স আর ঝাকড়া চুলে ফিতে বাঁধা আফসার উপচে পড়া ভিড়ের হাজার হাজার মানুষকে মাতিয়ে তুলতেন। লন্ডনের কে.এস.আর কোম্পানি এস.এল বের করেছে তাঁর অডিও সিডি ‘চিকন কালা'”। এই হলেন মোয়াজ আফসার। তিনি জীবন ও কাজের সাথে তাঁর স্বপ্ন-সাধনাকে এক করে মিলিয়ে নিয়ে সৃষ্টি করেছেন ‘শেক্সপিয়ারের দেশে’ গ্রন্থটি। চারকালার কম্বিনেশন অপূর্ব ছাপায় প্রতি অধ্যায়ে লেখার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ দৃষ্টিনন্দন রঙিন ছবি সংযোজন বইটিকে অন্য এক মাত্রা দিয়ে মেহনীয় করে তুলেছে। বইটি হাতে নিলেই মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং পাঠের উদগ্র বাসনা জাগায়। আমি লেখক জনাব মোয়াজ আফসারের কাছ থেকে আরো আরো লেখা প্রত্যাশা করে ‘শেক্সপিয়ারের দেশে’বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
লেখক জনাব মোয়াজ আফসারের শুভ জন্মদিনে সতত শুভেচ্ছা।

পুলিন রায়
ভাস্করভবন, গোপালটিলা, টিলাগড়, সিলেট।

শেয়ার করুন