বরেণ্য স্কলার শায়খ ইসহাক আল মাদানী

বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল

শায়খ ইসহাক আল মাদানী একজন প্রজ্ঞাবান আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও প্রখ্যাত গবেষক ছিলেন। ইলমে দ্বীনের প্রচার, প্রসার এবং এক্বামাতে দ্বীনের কাজ ও সমাজ সংস্কারে যে ক’জন আলেম নিরলসভাব কাজ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শায়খ ইসহাক আল মাদানী। তাঁর মননশীল এবং বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা-চেতনা মুসলিম উম্মাহকে প্রতিনিয়ত উপকৃত করেছে। সমাজ ও দেশের পরিচয় ছাপিয়ে শায়খ ইসহাক আল মাদানী বিশ্ব পরিমণ্ডলে বিশেষ করে আরব দুনিয়ার আলেম সমাজের মধ্যে তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব সম্মানজনক আসন। তাঁর প্রখর মেধা, বিনয়, দক্ষতা, পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ইলমে দ্বীনের প্রতি অকৃত্রিম পিপাসা আলেমদের সরেতাজ বানিয়েছে। শায়খ ইসহাক আল মাদানী আরবী ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক হিসেবে স্বকীয়তা নির্মাণে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। যা বাংলাদেশের জন্য নিয়ে এসেছে এক বিরল গৌরব ও কৃতিত্ব। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রত্যাশী শায়খ ইসহাক আল মাদানী ঐক্যের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। উম্মাহর প্রতি তাঁর দরদ আলেম সমাজকে করেছে অভিভূত। এজন্য বিভিন্ন ধারার আলেমদেরকে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে আনতে কাজ করেছেন। অর্জন করেছেন মহতি সাফল্য। তাই তো তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। রাজনীতির ছদ্মাবরণে উম্মাহকে বিভক্ত করার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। তাঁর কর্মস্পৃহা, কর্ম-প্রেরণা, কর্ম-উদ্দীপনা, এখলাস-মুজাহাদা তাঁকে একজন আদর্শ দাই ইলাল্লাহে পরিণত করেছিল।

শায়খ ইসহাক আল মাদানীর জন্ম ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নের বাউসী গ্রামের টিলাবাড়িতে। তিনি ছোটবেলা থেকেই একটি ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি পরিবারে বড় হয়ে উঠেন। তার বাবা আলহাজ্ব ইসবর আলী (রহ.) এবং পিতামহ ওয়াজেদ আলী (রহ.) এলাকায় একনিষ্ট সমাজসেবক ও পরহেজগার ব্যক্তি হিসেব সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর মাতা মুহতারামা চাঁদ বিবি (রহ.) ছিলেন পূণ্যবতী নারী। একটি দ্বীনি পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে তিনি ছোটবেলা থেকেই আলেমদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের নেক দোয়া ও ভালোবাসা অর্জন করেন। বিশেষ করে কুতবুল আলম, আওলাদে রাসুল (সা.) শায়খুল ইসলাম আরব ওয়াল আজম হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর সুযোগ্য খলিফা ফুলবাড়ির শায়খ আবদুল মতিন চৌধুরী, ফুলতলীর পীর শায়খ আবদুল লতিফ চৌধুরী (রহ.) এবং জায়ফরপুরের হাফিজ মাওলানা নূরুল মুত্তাকিন সাহেবদের নেক দোয়া তার জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলে। এছাড়াও এসব হক্কানী আলেমদের সাথে তাঁর পরিবারের ছিল বিশেষ হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। তাঁদের নেক দোয়া তাঁর ইলম অর্জনের পথে পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ তায়া’লা ইলম অর্জনের জন্য তার অন্তরকে খুলে দেন। যার দরুণ শিক্ষা জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

শায়খ ইসহাক আল মাদানীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাউসী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে সিলেটের সুপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফুলবাড়ী আজিজিয়া আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। প্রখর মেধার অধিকারী ইসহাক আল মাদানী এখান থেকেই দাখিল ও আলিম পাশ করেন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড থেকে। শুধু তাই নয়, দুটি পরীক্ষায় তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষরস্বরূপ প্রথম বিভাগে মেধাস্থান দখল করেন। তিনিই প্রথম ফুলবাড়ী মাদরাসার মেধাস্থান অধিকারী কৃতিছাত্র ছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ঐতিহ্যবাহী সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ফাজিল ক্লাসে ভর্তি হন। সরকারি মাদরাসা থেকে ফাজিল ও কামিল পরীক্ষা দিয়ে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে প্রথম বিভাগে মেধাস্থান দখল করার গৌরব অর্জন করেন। কামিল হাদীসে তাঁর অসাধারণ কৃতিত্ব দেখে বিশেষ করে মুসলিম শরীফে একশ-এর মধ্যে প্রাপ্ত নম্বর ৯২ দেখে ফাজিল দেওবন্দ মরহুম ফজলে হক (ফাজিল সাহেব) তাঁকে মাদরাসায় ডেকে এনে তাঁর কল্যাণের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেন।

১৯৭৫ সালে মদনমোহন মহাবিদ্যালয় সিলেট থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে মানবিক গ্রুপে কুমিল্লা বোর্ডে প্রথম বিভাগে নবম স্থান লাভ করে মাদরাসা ছাত্র হিসেবে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আরবী ভাষা ও সাহিত্যে’ অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। ঢাকা মহসিন হলের বোর্ডার হয়ে দু’বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্র মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশীপ লাভ করেন। শায়খ ইসহাক ঐ তিনজনের মধ্যে ছিলেন অন্যতম।

১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শায়খ ইসহাক সৌদি সরকারের বৃত্তি নিয়ে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ‘ডিপ্লোমা ইন এরাবিক ল্যাংগুয়েজ’ দু’বছরের কোর্স ছয়মাসে সম্পন্ন করে একশত দুটি দেশের স্কলার ছাত্রদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ৩য় মেধাস্থান অধিকার করে দেশের জন্য এক অভিনব গৌরব বয়ে আনেন। অতঃপর তিনি ‘আরবী ভাষা ও সাহিত্যে লিসান্স’ কোর্সে ভর্তি হন। সুদীর্ঘ চার বছরের এ কোর্সে তিনি বাংলাদেশের জন্য বিরল কৃতিত্ব বয়ে আনেন। বিশ্বের ৭০টি দেশের স্কলার ছাত্রদের সাথে প্রতিযোগিতা করে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে একমাত্র ‘মমতাজ’ উপাধি লাভ করেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশী যিনি ‘আরবী ভাষা ও সাহিত্যে’ এ বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হন। তাঁর শতকরা গড় মার্ক ছিল ৯১.৮%। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করে ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগে এম.এ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে আরেক বিরল কৃতিত্ব স্থাপন করেন। অতঃপর ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ফিল করেন। পরবর্তীতে পিএইচডি করার সুযোগ লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় হচ্ছে-‘বৃহত্তর সিলেটে মাদরাসার ইতিবৃত্ত’। তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর ড. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি সৌদি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকায় মন্ত্রণালয় কর্তৃক ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে পিএইচডি সম্পন্ন করতে পারেন নি।

শায়খ ইসহাক আল মাদানীর দেশের প্রতি ছিল অকৃত্রিম টান। বিশেষত দ্বীনের জন্য, উম্মাহর জন্য। ছাত্রজীবনের প্রতিটি অধ্যায় তাঁর স্বর্ণোজ্জল। চাইলেই সৌদি আরবে বসে দ্বীনের জন্য বৃহত্তর খেদমত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর দেশ, মাটি ও মানুষের চিন্তা করলেন। উম্মাহর দরদ তাঁর হৃদয়ে পেরেকের মত আঘাত করতে লাগলো। দেশের মাটিতে বসেই আল্লাহর দ্বীনের কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দেশে চলে আসলেনও। এখানেই তাঁর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় প্রতিভাত। মক্কা ও মদীনা দুটি স্থান বিশ্বমানবতার প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এখানেই লালিত পালিত হয়েছেন সরদারে কায়েনাত। প্রতিটি মুমিন হৃদয়ের সুপ্ত বাসনা এই দুটির একটিতে যেন তার মৃত্যু হয়। এটা রাসুল (সা.) এর প্রতি ভালোবাসারও বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু শায়খ ইসহাক আল মাদানী দ্বীনের কাজের মাধ্যমে রাসুল (সা.) এর ভালোবাসার প্রমাণ দিতে চাইলেন। জীবদ্দশায় আল্লাহর দ্বীনের জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন।

মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বিরল কৃতিত্বের জন্য সৌদি সরকার তাদের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে তাঁকে চাকুরী প্রদান করে। ১৯৮৩ সাল থেকে তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে সিলেটে কর্মরত ছিলেন। ডেপুটেড শিক্ষক হিসেবে কয়েক বছর মীরাবাজার জামেয়ায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৯২ সাল থেকে ডেপুটেড শিক্ষক হিসেবে শাহজালাল জামেয়া পাঠানটুলা মাদরাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষা-বিস্তারের পাশাপাশি সিলেট বিভাগের অনেক মসজিদ, মাদরাসা, ইসলামী পাঠাগার ও এতিমখানা সৌদি অনুদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে তিনি সহযোগিতা করেন। কাবা শরীফের প্রধান ইমাম আব্দুল্লাহ সুবায়েলসহ আরববিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী ব্যক্তিত্বরা যখন সিলেট সফর করেন তখন তিনি দুভাষীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আরব বিশ্বের কাছে একজন পরিচিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাংলাদেশের যেসকল ছাত্র সৌদি আরবের বিভিন্ন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে ডিগ্রি লাভ করছেন তিনি তাদের সংগঠন ‘সৌদি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি আরবি ভাষার প্রসারের লক্ষ্যে সরকারি-আধাসরকারি ও বেসরকারি বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠানে স্বল্পকালীন আরবী ভাষার কোর্স পরিচালনা করেছিলেন। ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনেক ক্লাস গ্রহণ করেছেন তিনি।

শায়খ ইসহাক আল মাদানী কুরআন- সুন্নাহর আলোকে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করতে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মানুষের দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তির লক্ষ্যে তাদেরকে সহিহ্ আক্বিদা শিক্ষা দিতেন। কিন্তু শিরক ও বিদআত মুসলিমের সেই স্প্রিট এবং প্রেরণাকে শেষ করে দেয়। শিরক মানুষকে আল্লাহ থেকে সরিয়ে দেয়। পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ করে। যার জন্য দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ হয়ে যায়। এজন্য শিরক ও বিদআত থেকে জাতিকে রক্ষার লক্ষ্যে তাঁরই সংগঠন সৌদি পরিষদ ১৯৯৮ সালে জাতীয় পর্যায়ে তাওহিদ বিষয়ক জ্ঞান প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে এবং একশটি আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সাময়িকীতে তাওহিদ, ইবাদত, শিরক, বিদআত বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লেখেন। ‘আততাওহিদ’ নামক সাময়িকীর সম্পাদনা করে বিনামূল্যে বিতরণ করেন। তিনি ‘তাওহিদ ও ইসলামী আক্বিদার গুরুত্ব, ইসলামে কবর যিয়ারত ও উরুস, মসজিদে নববীর যিয়ারত ও আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা অর্জনের দশটি উপায়’ নামক চারটি ছোট ছোট পুস্তিকা রচনা করেন। যেগুলো ছাপা হয়ে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। তিনি ছোটদেরকে আরবি ভাষা শিক্ষাদানের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত বইগুলো লিখেছেন, যেগুলো বিভিন্ন কিন্ডার গার্টেন স্কুলে সিলেবাসভুক্ত রয়েছে। এগুলো হল- রাওযাতুল আতফাল, দিরাসাতুল আরাবিয়াহ, সিরিজ ১ থেকে ৫ পর্যন্ত, নাসিমুল আরাবিয়াহ। শায়খ ইসহাক আল মাদানী মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় আরবী ভাষায় শতাধিক পৃষ্ঠা সম্বলিত তিনটি বিষয়ে গবেষণা করেছেন। এগুলো হল- ‘স্পেনে আরবি সাহিত্যের বিকাশ’ গাইড মিশরের ড. আবদুল্লাহ আল ফারাহ. ‘মিশরে আধুনিক আরবি সাহিত্যের বিকাশ’ গাইড মিশরের ড. ফাখের, ‘আরবি অলঙ্কার শাস্ত্রে আব্দুল কাহির জুরজানির অবদান’ গাইড ড. ইজুদ্দীন (মিশর)। তাঁর এ তিনটি গবেষণাকর্ম আরবি ভাষাভাষীর কাছে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে দিয়েছিল। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাঁর এ পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা দেখে অভিভূত হয়ে তাঁকে ছাত্রাবস্থায় ড. ইসহাক বলে সম্বোধন করতো।

শায়খ ইসহাক আল-মাদানী অত্যন্ত উদার দীল এবং প্রশস্ত চিন্তার অধিকারী। এজন্য তিনি উম্মাহর ঐক্য প্রত্যাশী ছিলেন। ইসলামের নামে দলাদলির ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। তবে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা খালিস-মুখলিসভাবে কাজ করছেন তাদেরকে সর্বদা ভালোবাসা এবং স্নেহের নজরে দেখতেন। তিনি মনে করতেন, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত জীবন থেকে আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত সর্বত্র আল্লাহর বিধান কায়েম করতে পারলে দুনিয়াতে যেমন সুখ-শান্তি পাওয়া সম্ভব, তেমনি আখেরাতেও কাক্সিক্ষত সুখ এবং মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে বিভক্তি এবং কোন্দল, পরস্পরকে আক্রমণ করার তীব্র নেশায় উন্মুখ, এমন প্রেক্ষাপটে উম্মাহর দরদ তাঁর অন্তরে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে যে, ইত্তেহাদ মাআল ইখতেলাফ নীতিকেই তিনি একমাত্র পন্থা বলে মনে করতেন। কারণ জোরজবস্তি করে কোনো দিন কাউকেও তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা এবং মসলক থেকে ফেরানো যায় নি। সুতরাং শিরক ও কুফরের প্রশ্নে আপোসহীন ভূমিকা ছাড়া সকল ছোটোখাটো মত-পার্থক্য ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকা সময়ের অনিবার্য দাবি। এছাড়া শায়খ ইসহাক আল মাদানীর নিজস্ব চিন্তা-চেতনা এমনই মনে করতেন, বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব এমন আকার ধারণ করেছে যে, শয়তানের পূজা করেও কেউ ঠিক ঠের পাচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষেই সমস্যা কোথায়? নিজস্ব চিন্তা-পদ্ধতি, মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠাতা করতে গিয়ে উম্মাহর ঐক্য বারবার বিনষ্ট হচ্ছে-এমন চিন্তায়ও তিনি বিভোর ছিলেন।

শায়খ ইসহাক আল মাদানী প্রখর মেধা এবং প্রজ্ঞাবান একজন আলেম বলেই উম্মাহর গোঁড়ার সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। আধ্যাত্মিকতা থেকে সরে যাওয়ার কারণেই উম্মাহ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে এমন চিন্তাকেই তিনি জোর দিতেন। একজন আলেম হিসেবে আলেমসমাজের দায়িত্বকে যথাযথভাবে আঞ্জাম দেওয়ার অনুপ্রেরণা তিনি দিয়ে থাকতেন। বর্তমান সময়ে আধুনিক জাহেলিয়াতের যুগে আলেমসমাজকে যুগের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং এর সমাধানের পথ ও পদ্ধতিকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে তিনি দিকপাল ছিলেন। ইলমে দ্বীনের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক তথা সার্বক্ষণিক ইলম চর্চা এবং এর প্রচার-প্রসারে জাহেলিয়াত দূর হবে বলে তিনি মনে করতেন। চিন্তা ও দর্শনের অঙ্গনে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ হচ্ছে না বিধায় উম্মাহ বারবার পিছিয়ে পড়ছে। মূলত চিন্তা এবং দর্শন তথা জীবন দর্শনে ইসলামীবিধানের সাংঘর্ষিক নিয়ম অক্ষত থাকলে এখানে ইসলামের বীজ রোপন খুবই কঠিন। তাছাড়া সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নিত্য-নতুন চিন্তা এবং দর্শনের সৃষ্টি হচ্ছে। যা ইসলামী জীবনবিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একজন আলেমকে চিন্তা ও দর্শনে এমনভাবে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে যে, সকল বাতিল মতবাদের অসারতা প্রমাণ করে ইসলামী দর্শনকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মত হিম্মত এবং যোগ্যতা তৈরী করে নিতে হবে। এভাবে শায়খ ইসহাক আল মাদানী চিন্তা ও দর্শনের অঙ্গনকে গুরুত্বদানের মাধ্যমে মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদানের স্বর্ণোজ্জ্বল সময়কেই ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। একজন ব্যক্তির অন্তরে গেড়ে বসা জাহেলিয়াত তথা চিন্তা ও দর্শনের গোড়ামিকে দূর করতে না পারলে ইসলাম তার অন্তরে স্থায়ীভাবে গেড়ে বসবে না।

ইলমে দ্বীনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় শায়খ ইসহাক আল মাদানীর ছিল নিগূঢ় বিচরণ। রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের ছাপ পাওয়া যায়। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের পর্যালোচনায় অত্যন্ত প্রখর, প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন, মুসলিম উম্মাহর অন্যতম সংকট হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট। পুজিঁবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বঅর্থব্যবস্থাকে শোষণের জঘন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। শায়খ ইসহাক আল মাদানী পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলোৎপাটনে আলেমসমাজকে ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করতেন। সুদমুক্ত ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য, মোয়ামেলা-মুআশারাত সম্পন্ন করার প্রেরণা তারা জনগণকে দিতে পারেন।

শিক্ষকতা, ধর্ম প্রচার ও লেখালেখি ছাড়াও তিনি নিয়মিত বিভিন্ন মসজিদে পবিত্র কোরআনের তাফসীর পেশ করতেন। প্রতি মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদে তাফসির পেশ করতেন। তিনি বিভিন্ন মসজিদে জুমআর দিন খুতবা দিতেন। জীবদ্দশায় হাউজিং এস্টেট আকল কুয়া মসজিদের খতীব পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিভিন্ন মাদরাসা পরিচালনা কমিটি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শরীয়াহ বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি তাহফিযুল কুরআন শিক্ষাবোর্ড সিলেট-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মোটকথা তিনি কুরআন, হাদিস, ফেকাহ ও আকাইদ শাস্ত্রে ছিলেন একজন দক্ষ ব্যক্তিত্ব। আরবি ও ইংরেজি ভাষায় ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। রাজনীতিতে তিনি ইসলামী ঐক্য ছাড়া দলাদলিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। শিরক ও বিদয়াতমুক্ত ইসলামী দাওয়াতে বিশ্বাসী ছিলেন। আর এটাই ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার পূর্বশত বলে মনে করতেন।

পারিবারিক জীবনে তিনি ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ সুরমার লাউয়াই দালানবাড়ি-এর মরহুম আবদুস শহীদের ২য়া কন্যা হাফসা খানম উরফে (বাবনা)-এর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ২ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের জনক। তারা হলেন- ফিরদৌসি মান্নাহ, জাকিয়া হান্নাহ, হাফিজ হাসান আল হাদী, তাকিয়া জান্নাহ, ছাদিয়া সুন্নাহ ও হোসাইন আল মাহদী।

দেশের বরেণ্য আলেম শায়খুল হাদীস আল্লামা শায়খ ইসহাক আল মাদানী ২০ জানুয়ারি ২০২৫ সকাল ৮:৩০ মিনিটের সময়ে সিলেটের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। জীবমাত্রই মরণশীল। জীবশ্রেষ্ঠ মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। অবধারিত জেনেও অনেকে মৃত্যুকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে চায় না। মৃত্যুকে ভুলে যেতে বা ভুলে থাকতে চায়। তাদের কেউ কেউ পার্থিব লোভ-লালসা ও ভোগবিলাসে এতই মত্ত থাকে যে, মৃত্যুর কথা তাদের স্মরণেরই আসে না। দুনিয়ার চাকচিক্যে যে কোনো ধরনের অন্যায়, অনাচার, অপকর্ম ও অপরাধ করতেও তারা দ্বিধা করে না। তাদের স্বভাব, আচার, ব্যবহার ও কর্ম থেকে মনে হয়, মৃত্যু কখনোই তাদের নাগাল পাবে না। মহান আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য হিসেবে মান্য করা, সৎকর্ম করা ও যাবতীয় অসৎকর্ম থেকে বিরত থাকা দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হওয়ার পূর্ব শর্ত হলেও তারা এসবে আমল দেয়ার গরজ অনুভব করে না। জীবন আনন্দের পরমার্থ অনুসন্ধানী এ পরম প্রিয় শায়খুল হাদীস আল্লামা শায়খ ইসহাক আল মাদানী আজ পরকালের বাসিন্দা। আমি তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং শোকাহত পরিবার পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিন এবং তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রকাশক ও সংগঠক।

শেয়ার করুন