মোহাম্মদ ইকবাল : আসুন পরিচিত হই ব্রিটিশ বাংলাদেশী প্রজ্ঞাবান কবি তাবেদার রসুল বকুল ও তাঁর কবিতার সাথে।
উপাত্ত :- তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ " নগরে নিজের বলে কেউ থাকে না"।
তাবেদার রসুল বকুলের কাব্যগ্রন্থ “নগরে নিজের বলে কেউ থাকে না” একটি ব্যতিক্রমী ও গভীরতা সম্পন্ন সাহিত্যকর্ম। এটি বাংলা কবিতার আধুনিক ধারা এবং ব্যক্তিজীবনের সংবেদনশীলতাকে এক মঞ্চে নিয়ে এসেছে। এখানে কবির কাব্যশৈলী, শব্দের ব্যবহার, উপমা, এবং দর্শনসমূহ বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হলো।
কাব্যশৈলী: সহজ, সংবেদনশীল এবং গভীর।
তাবেদার রসুল বকুলের কবিতাগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার সহজ, অথচ গভীরতর প্রকাশভঙ্গি। কবিতাগুলোর ভাষা সরল হলেও এর অন্তর্নিহিত অর্থ বহুস্তরীয়। প্রতিটি কবিতা পাঠকের হৃদয়ে একটি স্থায়ী ছাপ ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, “ফেলানী” কবিতার একাধিক স্তরে ব্যথা, প্রতিবাদ এবং জাতীয়তাবোধের চিত্র ফুটে ওঠে। “কাঁটাতারে ঝুলে আছে যুবতীর লাশ”—এই এক পঙক্তিতেই কবি সীমান্তে ঘটে যাওয়া মানবিক ট্র্যাজেডিকে জীবন্ত করে তুলেছেন।
কবির শৈলী এমন যে, তিনি কথাগুলো সরাসরি বলেন না; বরং শব্দ ও ভাবের এমন সমন্বয় ঘটান যা পাঠককে ভেতর থেকে নাড়া দেয়।
শব্দের ব্যবহার: মিতব্যয়ী অথচ বহুমাত্রিক।
তাবেদার রসুল বকুলের কবিতায় শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত মিতব্যয়ী। তিনি অপ্রয়োজনীয় শব্দ এড়িয়ে গেছেন এবং এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যা মুহূর্তেই একটি চিত্রকে জীবন্ত করে তোলে। যেমন, “কুত্তার বাচ্চারা” কবিতায় “কুত্তার বাচ্চা” শব্দগুচ্ছ সামাজিক দানবদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট। এই সরাসরি আক্রমণাত্মক শব্দচয়ন কবির সাহসিকতার প্রমাণ।
“পথ ফুরায় না” কবিতায় “হাজারও মানুষ থাকে নগরে, নিজের বলে কেউ থাকে না”—এই একটি লাইন নগরজীবনের শূন্যতা এবং মানুষের আত্মিক একাকীত্বকে দারুণভাবে উপস্থাপন করেছে। এখানে ‘নগর’, ‘মানুষ’, এবং ‘নিজের বলে কেউ থাকে না’ শব্দগুচ্ছ জীবনের এক গভীর সত্য তুলে ধরেছে।
উপমা ও রূপকের জাদুকরী ব্যবহার:
বকুলের কবিতার আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো তার উপমা ও রূপকের ব্যবহার। “ঠোঁট” কবিতায় “তোমার ঠোঁটে জেগেছে পূর্ণিমার লাল চাঁদ, আমার বুকে জমেছে গাঢ় কালো মেঘ”—এখানে ভালোবাসা ও বেদনার রূপক দুটি বিপরীত অনুভূতিকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়েছে।
“দেউলিয়া” কবিতায় ভালোবাসাকে নিলামের সঙ্গে তুলনা করে কবি প্রেমের বাজারি স্বভাব এবং ভালোবাসার প্রতি মানুষের দায়িত্বহীনতার চিত্র এঁকেছেন। এই উপমা কবিতার ভাবনার গভীরতাকে আরও প্রগাঢ় করেছে।
“বেহিসাবি ঋণ” কবিতায় ভালোবাসার ঋণ এবং সেই ঋণের কিস্তি দিতে না পারার অসহায়ত্বও উপমার মাধ্যমে অত্যন্ত সুকৌশলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
দর্শন: অস্তিত্বের অন্বেষা এবং সময়ের খেলা।
তাবেদার রসুল বকুলের কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার দার্শনিক মনোভাব। কবিতাগুলোতে তিনি অস্তিত্ব, জীবন, এবং ভালোবাসার বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা করেছেন।
“বিশ্বাস” কবিতায় জীবনকে “সময়ের খেলা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জীবনের অনিশ্চয়তাকে মনে করিয়ে দেয়। কবি এখানে বলছেন, “বিশ্বাস রাখতে পারলে না, শতভাগ বিশ্বাস”—যেন জীবনের একমাত্র অনিবার্য বিষয় হলো সময় এবং পরিবর্তন।
“পথ ফুরায় না” কবিতায় কবি মানুষের অন্তহীন খোঁজের চিত্র এঁকেছেন। এখানে “পথ” হলো জীবনের প্রতীক। এই কবিতার মাধ্যমে কবি দেখিয়েছেন, মানবজীবন হলো এক অন্তহীন যাত্রা, যেখানে পথ কখনও ফুরায় না।
“ক্যামেরায় বন্দি” কবিতায় স্মৃতি এবং মুহূর্তের প্রতীকী রূপায়ণ দেখা যায়। “সোনালি বিকেল” একটি সুন্দর সময়ের ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু সেই মুহূর্তের ক্ষণস্থায়িত্বকে ক্যামেরায় বন্দি করার চেষ্টায় মানুষের অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়।
মানবিকতা ও সমাজের অসঙ্গতি:
বকুলের কবিতাগুলোতে মানবিকতা এবং সমাজের নানা অসঙ্গতির প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। “ফেলানী” এবং “কুত্তার বাচ্চারা” কবিতায় কবি একদিকে সীমান্ত হত্যার করুণ চিত্র এঁকেছেন, অন্যদিকে সমাজের লোভী ও অমানবিক চরিত্রের মুখোশ উন্মোচন করেছেন।
“ব্যারিকেড” কবিতায় তিনি ক্ষমতার ব্যারিকেড ভেঙে যাওয়ার এক সাহসী প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এখানে “বেকসুর খালাস” কথাটি একজন অভিযুক্ত মানুষের নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার আনন্দের পাশাপাশি সমাজের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তির ইঙ্গিত দেয়।
ভালোবাসার গভীরতা ও ব্যর্থতা:
ভালোবাসা তাবেদার রসুল বকুলের কবিতায় বারবার ফিরে আসে। তবে এটি কখনও সরল আনন্দের নয়; বরং এতে থাকে বেদনা, ঋণ, এবং অপূর্ণতার ছাপ। “দেউলিয়া” এবং “বেহিসাবি ঋণ” কবিতায় ভালোবাসার প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত বাস্তব ও গভীর।
ভালোবাসা কবির কাছে কেবল অনুভূতি নয়, এটি একটি দায়বদ্ধতা। “বেহিসাবি ঋণের কিস্তি দিতে পারিনি আমি”—এটি ভালোবাসার প্রতি মানুষের অসফল প্রতিশ্রুতি ও ব্যর্থতা প্রকাশ করে।
নগরজীবনের একাকীত্ব এবং আত্মপরিচয়ের সংকট:
“পথ ফুরায় না” এবং “নগরে নিজের বলে কেউ থাকে না” কবিতাগুলোতে নগরজীবনের শূন্যতা এবং মানুষের একাকীত্বকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
নগরের হাজারো মানুষের মাঝে থেকেও মানুষের যে একাকীত্বের অনুভূতি হয়, সেটি কবি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। এখানে নগরজীবন শুধু বাহ্যিক চাঞ্চল্যের নয়; এটি অন্তর্গত শূন্যতাও বহন করে।
কবিতার রূপ ও গঠন:
তাবেদার রসুল বকুলের কবিতাগুলো ছোট ছোট পঙক্তিতে সাজানো, যা কবিতার ভাবকে আরও গভীর করে তোলে। কবিতার ছন্দময়তা সরাসরি নেই, তবে এর অন্তর্গত ধ্বনিমাধুর্য ও অর্থময়তা পাঠককে আকৃষ্ট করে। প্রতিটি কবিতা একটি বিশেষ ভাব বা অনুভূতির প্রতি নিবেদিত।
সমাপ্তি ভাবনা:
“নগরে নিজের বলে কেউ থাকে না” কাব্যগ্রন্থটি শুধু কবিতার একটি সংগ্রহ নয়; এটি একটি সময়, অনুভূতি এবং মানবিকতার দলিল। কবি তাবেদার রসুল বকুল তার শব্দচয়ন, উপমা, এবং গভীর দর্শনের মাধ্যমে পাঠকের সামনে জীবনের বাস্তবতা এবং অনিশ্চয়তা তুলে ধরেছেন।
এই গ্রন্থ আমাদের ভালোবাসা, একাকীত্ব, এবং অস্তিত্বের প্রশ্ন নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। এটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এবং একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি।
সম্পাদকঃ আব্দুল বাতিন ফয়সল
সহ-সম্পাদকঃ আব্দুল মুহিত দিদার
মোবাইলঃ ০১৭৩০১২২০৫১
sylhetexpress.net