আনোয়ার শাহজাহান, তিউনিশিয়া হতে::
আমার জন্মভূমি #সিলেটের_গোলাপগঞ্জ উপজেলার #রায়গড় গ্রাম। একদম সহজ, সাদামাটা কিন্তু অশেষ প্রিয় সেই গ্রামটি, যেখানে বাড়ির সামনের কাকি ছড়ার শান্ত স্রোত, গাছের ডালপালা, মাঠে ফোঁটানো ফুল আর গ্রামের মানুষের অটুট হাসি সবকিছুই জীবনের অনুভূতির মূল উৎস ছিল। সেখানে জীবন ছিল শৃঙ্খলা আর শান্তির মিশেল। কিন্তু একসময়, সেই সুন্দর গ্রামটিকে পেছনে রেখে, অনেক স্বপ্ন আর নিজেকে নতুন করে চেনার আশায় ১৯৯৫ সালের ৯ মার্চ লন্ডন এসেছিলাম। সেদিন ছিল এক অদ্ভুত অনুভূতি, এক নতুন অভিযানে পা রাখার মুহূর্ত।
১৯৯৬ সালে বিবাহিত হই, এবং ১৯৯৭ সালে আমাদের প্রথম সন্তান তানভীরের জন্ম হয়। আজ, সেই ছেলে নিজেও বিবাহিত, জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছে। দ্বিতীয় ছেলে এখন ২৩ বছর বয়সী, এবং আমাদের মেয়ে দুটি ১৯ ও ১৩ বছরের। ছোট ভাই মুরাদের বড় ছেলে ২৪ বছর বয়সী, আর সে এখন পাঁচ সন্তানের গর্বিত পিতা। সময় যেন এক মহাকালের নদী, যা চিরকাল প্রবাহিত হয়ে চলে, কখনো ধরা দেয় না, কিন্তু তার তীব্রতায় প্রতিটি মুহূর্ত গড়িয়ে যায়।
আজ, আমি এবং ছোট ভাই মুরাদ তার পরিবারসহ #আফ্রিকার_তিউনিশিয়ায় এসেছি, আর আমাদের সঙ্গে রয়েছে পুত্রবধূও। তিউনিশিয়ার সমুদ্রসৈকতে বসে, সন্তানদের খেলা উপভোগ করছি। তাদের প্রাণবন্ত খেলা দেখতে দেখতে, আমার মন চলে যায় অতীতে, যেখানে আমার জীবনের প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছিল। জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, সবকিছু যেন মুছে যেতে বসেছে। কিন্তু যখনই এমন মনে হয়, তখনই আমার সামনে দৃশ্যমান হয় আমার পরিবার, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের পথচলার সব স্মৃতি, আর সেই প্রিয় গ্রাম—রায়গড়।
আজ যখন আমার জীবনের এই পরিবর্তনগুলো দেখি, তখন উপলব্ধি করি কত দ্রুত সময় চলে গেছে। এখন আমরা এক বিশাল পরিবার, যেখানে ৭ ভাই ও ৬ বোনের সন্তান সংখ্যা ৪৭ তে পৌঁছেছে, এবং নাতি-নাতনির সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। নতুন প্রজন্মের মুখে হাসি, তাদের আনন্দ, একে অপরের প্রতি ভালোবাসা—সবকিছুই আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক। এটি আমাদের অতীতের পরিশ্রম, আমাদের সংগ্রামের ফল।
আমার সন্তানদের খেলা দেখতে দেখতে, তাদের হাসি শুনতে শুনতে মনে হয়, আমাদের সংগ্রাম কেবল আমাদের জন্য ছিল না। এটি ছিল পরবর্তী প্রজন্মের সুখ আর শান্তির জন্য। তাদের যে আনন্দ উপভোগের মুহূর্ত, তার পেছনে রয়েছে আমাদের কঠোর পরিশ্রম, আমাদের প্রতিটি মুহূর্তের ত্যাগ। আমাদের জীবনের সার্থকতা, আমাদের জীবনের আনন্দের মূল মন্ত্র হলো—আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের শিকড়, আমাদের পরিবারের প্রতি ভালোবাসা।
এখন আমি স্বপ্ন দেখি, যখন আমার সন্তানরা বড় হবে, তাদের বিবাহ পর্ব শেষ হবে, তারা তাদের নিজস্ব জীবন শুরু করবে, তখন আমি এবং আমার স্ত্রী দেশের পথে রওনা হবো। সেই দেশে ফিরে যাবো, যেখানে আমি জন্মেছি, যেখানে আমার শৈশব কাটিয়েছি, যেখানে আমার জীবনের প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিল। স্বপ্ন দেখি, সেই গ্রামের রাস্তা, গাছ, কাকি ছড়া, আর সেখানকার মানুষের সঙ্গে আবার মিলিত হবো—যেখানে আমি বড় হয়েছি, যেখানে পরিবারে স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অটুট।
জীবনে চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। তবুও জানি একদিন আমাদের পথচলা ফিরবে সেই শিকড়ে, সেই গ্রামে, যেখানে সব কিছু আমার জন্য পরিচিত এবং অতি প্রিয়। এই হলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন—একদিন সেই গ্রামে ফিরে গিয়ে সারা জীবন কাটানো, যেখানে সবকিছুই আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। জীবনের সেই স্নিগ্ধ সময়টুকু, যেখানে শান্তি আর সুখের নিঃশব্দ অনুভূতি, একে অপরের পাশে বসে থাকার সুখ।
জীবন একটি চলমান নদী। আমরা কেবল তার তীরে বসে, ভেসে যেতে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে থাকি। মাঝেমাঝে মনে হয়, কিছু হারিয়ে ফেলা, কিছু পেতে ভুলে যাওয়া। কিন্তু তবুও, এই নদীর স্রোত যেমন আমাদের অগ্রসর করে, তেমনি শিকড়ের গভীরতা আমাদের ঠিক পথে রাখে। জীবনের এই যাত্রায় আমাদের পরিচয়, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের পরিবার, আমাদের ঐতিহ্য সবকিছুই অন্তরের গহীনে জমে থাকে।
এই হলো জীবন—এক অসীম যাত্রা, যেখানে সবকিছু আসে, চলে যায়, কিন্তু আমাদের শিকড়, আমাদের পরিবার, আমাদের ইতিহাস সবসময় একটাই থাকে—এটি আমাদের আত্মার গভীরে স্থির থাকে।
তিউনিশিয়া, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪।