সরওয়ার ফারুকী :
সাহিত্যের ছোটোকাগজ পাপড়ি, আগস্ট ২০২৪, এ সংখ্যাটি কবি মুকুল চৌধুরীকে নিবেদিত। কবি মুকুল চৌধুরীর ছেষট্টিতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত এ সংখ্যা বেশ সমৃদ্ধ,বহুজনের সাহিত্য-সমালোচনায় ঋদ্ধ। গুণী এ কবির বহুমাত্রিক সাহিত্যকর্মের মোকাবিলায় দু’একটি সংখ্যা যথেষ্ট না-হলেও এ কবিকে নিয়ে আলোচনার যে যাত্রা শুরু হলো— পাপড়ি সে যাত্রাপথের প্রধান রাহবর। একটি বিশেষ সংখ্যায় যা-যা দরকার, তার প্রায় সবটুকু বিশেষ এ সংখ্যায় রয়েছে। ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত সংখ্যায় সূচিধারা; মূল্যায়ন (কবিতা), অন্তরঙ্গ কথামালা, মূল্যায়ন (প্রবন্ধ), গ্রন্থালোচনা, নিবেদিত পঙক্তিমালা ও সাক্ষাৎকার। নয়জন গুণী কাব্য-সমালোচকের ছোঁয়ায় কবির কাব্যাকাশের প্রোজ্জ্বল যে রঙ বিচ্ছুরিত হয়েছে— কবি মুকুল চৌধুরীকে জানতে তা পাঠকদের নিশ্চয় উৎসাহী করবে।
অন্তরঙ্গ কথামালা অধ্যায়ে স্মৃতিকথা জানিয়েছেন তিন কবিবন্ধু আসাদ বিন হাফিজ, আবুল কাশেম জিল্লুর রহমান জিলানী ও মোঃ আমিনুল ইসলাম। তাদের গল্পে কবির চিন্তা, কর্ম ও ব্যক্তিসত্তার আন্দাজ পাওয়া যায়, তারা কবির সরল মন ও উম্মাহপ্রেমী হৃদয়ের স্বীকারোক্তি করেছেন। যেমন; আবুল কাশেম জিল্লুর রহমান জিলানী লিখছেন, “কবিতাসহ সব ব্যাপারে মুকুলের সাথে আমাদের অন্য সহপাঠী ইমরানের চলত চরম বিরোধ, যা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। তবে এ বিরোধ শত্রুতার নয়, ভালোবাসার”— মুকুল চৌধুরী সত্যিই ভালোবাসার মতো একজন মানুষ।
মুকুল চৌধুরীর প্রবন্ধ মূল্যায়ন করেছেন ছয়জন প্রাবন্ধিক, গ্রন্থালোচনায় আটজন। কবির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাব্বির আহমদ। একজন কবিকে বোঝার জন্য ‘সাক্ষাৎকার’ শক্তিশালী এবং জরুরি এক মাধ্যম। সাব্বির আহমদ সাক্ষাৎকাপর্বে বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, কবির রূহ যেন বের করে এনেছেন কাগজের পাতায়। এ সাক্ষাৎকার এ কবিকে বোঝবার জন্য দলিল হয়ে থাকবে।
কবিকে নিবেদিত পঙক্তিমালায় আছেন বিশজন কবি— কবি কালাম আজাদ থেকে শুরু করে এ প্রজন্মের শক্তিমান কিশোর কবি নাঈমুল ইসলাম গুলজার পর্যন্ত। শক্তিমান এ কবির জন্য নিবেদিত অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছে আমার কবিতা ‘যখন মুকুল আসে’
যখন মুকুল আসে—
বাতাসে সুনামি নামে ঘ্রাণের, প্রাণের,
আমোদিত বাংলার কৃষ্ণমঞ্চে নাচে যৌবনের লেজ।
যখন মুকুল আসে—
পাখির ঠোঁটেরা খোটে জীবনের বীজ,
উতল ফুলেরা ফোটে বিবাগী এ মৌসুমের দেশে।
যখন মুকুল আসে—
কৃষ্ণের বাঁশিতে ওঠে রাধিকার হাসি,
ছায়াপথ মায়া ছেড়ে নেমে আসে শ্যামলায়।
যখন মুকুল আসে—
সিলেটের কবি যাঁরা হেসে ওঠে হুরের মতোন,
অফুরান ভালোবেসে করে তাঁর অসীম যতন।
মুকুল চৌধুরী কবিদের কবি, সমঝদারের কবি। ঠোঁটের ভাষার বিপরীতে নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ উপমা-উৎপ্রেক্ষার অবাধ প্লাবন তার কবিতায়। উপমা-উৎপ্রেক্ষার এই প্লাবন তাঁকে স্বকীয় করলেও সাধারণ পাঠকদের মাহরূম রেখেছে তার কাব্যের পাঠ থেকে। সুদূর সময়কাল ধরে কবিতার সাথে জনতার যে দেয়াল— মুকুল চৌধুরী সে দেয়াল ভাঙতে যাননি, বরং দেয়ালের একপাশে একা-একা খেটেখুটে বুনেছেন আপন কাব্যের বাগান। তাঁর এ বাগানে প্রবেশাধিকার সীমিত—কেবল কবি যারা— তারাই। তার কাব্যের ভেদ ভাঙতে, খুঁড়ে-খুঁড়ে হীরে-জহরত বের করতে যে কাব্যজ্ঞানের প্রয়োজন— তা সাধারণের নেই, কবি-কাব্যের এ দিকটা কাব্যালোচনায় ওঠে আসেনি। এই একতিল ত্রুটি ছাড়া পাপড়ির সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক, বিশেষকরে কবি মুকুল চৌধুরীকে যতবার ভাববেন, যেভাবেই পাঠ করবেন, ততবারই এ সংখ্যার প্রয়োজন হবে। গুণে-মানে, ওজনে এ সংখ্যার মূল্য অপরিসীম। মুকুল-কাব্যের বর্ণবৈচিত্র জানতে, বুঝতে এ সংখ্যার দ্বারে ফিরতে হবে বারবার— এখানেই পাপড়ির সাফল্য।
পাপড়ির সত্ত্বাধিকারী কবি কামরুল আলম দেশব্যাপী পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত এক ছড়াকার। কবি ও প্রকাশক— এ দুই সত্তা ধারণ করে সিলেটের সাহিত্যাঙ্গনে উদীয়মান এক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছেন তিনি। নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি, কবিদের সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে নাচছে তার মাহফিল, পাপড়ির দেয়ালে থরে-থরে জমছে কিতাবের বিতান। সাহিত্যের জন্যে নিবেদিত এ কবি ও তাঁর প্রতিষ্ঠান পাপড়ি’র জন্য অকৃত্রিম শুভকামনা।