ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও আলোচিত রাজনৈতিক কর্মী শরিফ ওসমান হাদি আর নেই। গুলিবিদ্ধ হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
সিঙ্গাপুরে হাদির চিকিৎসা তত্ত্বাবধানে যুক্ত থাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা রাত ১০টার দিকে প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজেও তাঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে।
এর আগে বুধবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, গুলিবিদ্ধ হাদির শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। ওই ঘোষণার পর থেকেই তাঁর জীবন নিয়ে শঙ্কা বাড়তে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দোয়া ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন অনেকে।
আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী বক্তব্যের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে শরিফ ওসমান হাদি বেশ আলোচিত ছিলেন। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, হামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এক নেতার সংশ্লিষ্টতা শনাক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্ত ওই ব্যক্তি ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে আলোচনা রয়েছে।
ঢাকা-৮ আসন থেকে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন হাদি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের উদ্যোগে সোমবার তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়।
দিবালোকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাচেষ্টার এই ঘটনার পর দেশে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘটনাটিকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, নির্বাচনের পথে গুপ্ত হামলা ও নাশকতা বাড়তে পারে।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক মাস আগেই হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন হাদি। গত নভেম্বরে নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাঁকে ফোন ও মেসেজ দিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁর দাবি ছিল, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ সমর্থকেরা তাঁকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছে। তবে জীবননাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ‘ইনসাফের লড়াই’ থেকে সরে দাঁড়াবেন না বলেও জানান তিনি।
ঝালকাঠির নলছিটি থেকে উঠে আসা শরিফ ওসমান হাদিকে শুরুতে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেখা যায়নি। মাদ্রাসার শিক্ষক বাবার সন্তান হাদি নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে আলোচনায় আসেন হাদি। ইনকিলাব মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ, শহীদ ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবিতে শাহবাগে ধারাবাহিক সমাবেশ আয়োজন করেন তিনি। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতেও নিয়মিত অংশ নিতে থাকেন। শুরুতে মুখপাত্র হলেও পরে সংগঠনটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর একটি সক্রিয় সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভে অংশ নেন হাদি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতেও তিনি ছিলেন সরব। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষেও প্রকাশ্যে মত দেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙার ঘটনায়ও তাঁকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিলেও পরে নতুন দল এনসিপিতে যোগ দেননি হাদি। বরং ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে কয়েক মাস ধরে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় ছিলেন। ফজরের নামাজের পর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাওয়া, বাতাসা-মুড়ি নিয়ে প্রচার, ভোটারদের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ ও ব্যয়ের হিসাব প্রকাশসহ নানা কর্মকাণ্ড তিনি নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরতেন।
ওসমান হাদিকে হত্যার ঘটনাকে নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘পলাতক শক্তির’ সহিংসতার সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখছে সরকার।
এই হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাব ১৪ জনকে আটক ও গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সালের বাবা মো. হুমায়ুন কবির (৭০), মা মোসা. হাসি বেগম (৬০), স্ত্রী সাহেদা পারভিন সামিয়া ও শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু।
অন্য গ্রেপ্তারদের মধ্যে আছেন মো. নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বল, মো. কবির, আব্দুল হান্নান, মো. হিরন, মো. রাজ্জাক, ফয়সালের বান্ধবী মারিয়া আক্তার এবং হালুয়াঘাট সীমান্তে মানব পাচারকারী হিসেবে পরিচিত সিমিরন দিও ও সঞ্জয় চিসিম।