
এস এ রশিদ :
ইটের পর ইট, তার উপর বেঁচে আছে শহরের মেহনতী শ্রমজীবী মানুষেরা যাদের পক্ষে কথা বলার লোক বলতে গেলে নেই । মানবিকতা আজও মরেনি তাই আজ কলম ধরেছি ন্যায়ের পক্ষে, মানবতার স্বপক্ষে। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন।শহরের ফুটপাত শুধু কংক্রিট আর ইটের পথ নয়। এটি একদিকে পথচারীর নিরাপদ চলাচলের জায়গা, অন্যদিকে হাজারো মানুষের জীবন ও জীবিকার ভরসা। প্রতিদিন আমরা এই ফুটপাত দিয়ে হাঁটি। কখনো বিরক্ত হই দোকান সাজানো দেখে, হাকডাক শুনে বা ভিড় দেখে। কিন্তু পথ চলতে একটু থমকে ভেবেছি কি—ওই মানুষগুলো কারা? কেন তারা ফুটপাতে বসে ব্যবসা করছে? তাদের ঘরে কেমন চলছে দিন?
প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা জটিল থেকে জটিল। শহরের ফুটপাত নিয়ে যখনই উচ্ছেদ অভিযান হয়, তখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায় রাস্তার শুরু থেকে শেষ। আমরা খুশি হই, মনে হয় শহরটা ঝকঝকে হলো। কিন্তু সেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভিযানের চিত্রের আড়ালে হারিয়ে যায় বহু পরিবার, বহু স্বপ্ন, বহু ছোট ছোট স্বপ্নবাজ মানুষের জীবনযুদ্ধ।
একজন বৃদ্ধা মা আছেন—ধরা যাক নাম তার আয়শা বেগম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে ভুগছেন। প্রতিদিন নিয়ম করে ওষুধ খেতে হয় তাকে। কিন্তু হঠাৎ একদিন তিনি লক্ষ্য করলেন ছেলে আর আগের মতো নিয়মিত ওষুধ আনছে না।
—“বাবা, তুমি আমার ওষুধ আনছ না কেন?” ছেলের মুখে কোনো উত্তর নেই, শুধু নিস্তব্ধতা।
আয়শা বেগমের ছেলের নাম মাহবুব। সে দীর্ঘদিন ধরে ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করে সংসার চালাত। হুটহাট এক উচ্ছেদ অভিযানে তার দোকান ভেঙে ফেলা হয়। পুঁজি নেই, ব্যবসার জায়গা নেই, আয় বন্ধ। ঘরের ভেতর নেমে আসে অশান্তি। বাচ্চাদের স্কুল ফি জমে যায়, ঘরভাড়া বাকি পড়ে, প্রতিদিনের বাজার চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
মাহবুব মায়ের হাত ধরে বলে—“মা, তুমি কষ্ট কোরো না। আমি কিছু একটা করব। কিন্তু এখন আর আগের মতো বসতে দিচ্ছে না। পুলিশ এলে তাড়িয়ে দেয়।”
মায়ের চোখ ভিজে ওঠে। তিনি মৃদু হাসি দিয়ে বলেন—“আমার ওষুধের দরকার নেই বাবা। আমি ভালো আছি।”
কিন্তু এই “ভালো আছি” আসলে ছিল এক অসহায় মায়ের অশ্রু লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টা।
এই দৃশ্য কেবল একটি পরিবারের গল্প নয়। প্রতিটি উচ্ছেদের পর শহরের হাজারো ঘরে এমন দৃশ্য নীরবে ঘটে চলে। কিন্তু আমরা, যারা শুধু পরিষ্কার ফুটপাত দেখি, সেসব ঘরের কান্না শুনতে পাই না।
শুধু দুঃখের গল্প নয়, ফুটপাত জুড়ে আছে লড়াই আর আশার গল্পও।
সালেহা বেগম প্রথম জীবনে ফুটপাতে শাড়ি বিক্রি করতেন। পুলিশ আসলে দৌড়াতেন, মালপত্র লুকিয়ে রাখতেন। ধীরে ধীরে সঞ্চয় করে আজ তার শহরের এক কোণে ছোট দোকান আছে। তিনি একদিন বলেছিলেন—“ফুটপাত আমার প্রথম স্কুল ছিল। যদি সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হতো, হয়তো আমি আজ ভিক্ষা করতাম।”
হাসিনা আক্তার ফুটপাতে ভাত-ভর্তা বিক্রি করতেন। প্রতিদিন শত শত মানুষ তার খাবারে ভরসা রাখত। সেই আয় থেকে ধীরে ধীরে একটি ছোট রেস্টুরেন্ট দাঁড় করিয়েছেন। হাসিনা বলেন—“ফুটপাত না থাকলে আমি হয়তো আজও বেকার ঘুরতাম।”
এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে—ফুটপাত কেবল অব্যবস্থা নয়, অনেক সময় মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্র।
ফুটপাত শুধু শহরের গরিব মানুষের জায়গা নয়, এটি গ্রামের মানুষদেরও আশ্রয়। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসে—চিকিৎসা, চাকরি, পড়াশোনা বা আত্মীয়-স্বজনের কাজে।
বড় বড় শপিং মল বা দোকানে তাদের সামর্থ্য মেলে না। ফুটপাত তাই তাদের কাছে ভরসার স্থান। এখানে তারা সস্তায় কাপড়, জুতা, খেলনা, ফল কিনতে পারেন।গ্রামের সাধারণ মানুষ যখন শহরে আসে, তারা প্রথমেই ফুটপাতে ভরসা খোঁজে। কারণ এখানে দরদাম করা যায়, দামও তুলনামূলক কম।
তাহলে প্রশ্ন হলো—যদি ফুটপাত না থাকে, এই মানুষগুলো কোথায় যাবে?
ফুটপাত দখলমুক্ত করা প্রয়োজন—এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। পথচারীর অধিকার রক্ষা করা জরুরি। কিন্তু সমস্যা হলো, যাদের উচ্ছেদ করা হয়, তাদের বিকল্প কী?
শুধু খালি ফুটপাত মানেই কি শহর সুন্দর? মানুষের জীবন-জীবিকা অন্ধকারে ঠেলে দিলে কি সেটিই সমাধান?
চুরি করলে হাত কেটে ফেলা সহজ, কিন্তু কেন সে চুরি করছে, সেটার সমাধান খোঁজা আরও জরুরি। একইভাবে ফুটপাত খালি করাই যদি সমাধান ধরা হয়, তবে হাজারো পরিবারকে অনাহারে ঠেলে দেওয়া হয়।
শহর সুন্দর রাখতে হলে পরিকল্পিত সমাধান দরকার। হুটহাট উচ্ছেদে সমস্যা আরও জটিল হয়। এর পরিবর্তে নেওয়া যেতে পারে কিছু কার্যকর উদ্যোগ। নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। দিনের ব্যস্ত সময়ে ফুটপাত খালি রাখা, আর বিকেলের পর বা নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। নির্দিষ্ট জোনে বাজার বসানো যেতে পারে, যাতে পথচারীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি না হয়।
এছাড়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সামান্য ফি নেওয়া যেতে পারে, এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং ব্যবসায়ীরাও বৈধ স্বীকৃতি পাবেন। আবার যাদের সম্পূর্ণভাবে ফুটপাত থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে, তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি। এতে যেমন শহরের ফুটপাত খালি রাখা সম্ভব হবে, তেমনি মানুষের জীবিকাও টিকবে।
শহরের ফুটপাত আসলে শহরেরই প্রতিচ্ছবি। এখানে আছে মানুষের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই, অশ্রু মেশানো স্বপ্ন।
আয়শা বেগমের অশ্রু, সালেহার দোকান, হাসিনার রেস্টুরেন্ট কিংবা গ্রামের মানুষের সস্তায় কেনাকাটা—সব মিলেই ফুটপাতের গল্প শহরের গল্প।
আমরা কি এসব গল্প ভুলে যেতে চাই? নাকি শুধু সিদ্ধান্ত নিয়ে সব মুছে ফেলতে চাই?
শহর হোক পরিচ্ছন্ন, ফুটপাত হোক পথচারীর। কিন্তু সেই সঙ্গে মানুষও বাঁচুক, পরিবারও টিকে থাকুক।
ফুটপাত উচ্ছেদ নয়, নিয়ন্ত্রণ করুন। কারণ বেঁচে থাকার অধিকারই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আইন। আইন মানুষের সুনিয়ন্ত্রণের জন্য, বিপদে ঠেলে দেয়ার জন্য নয়।
লেখক:বিভাগীয় প্রধান,রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
লতিফা-শফি চৌধুরী মহিলা কলেজ
চেয়ারম্যান :সিলেট সেন্টার ফর ইনফরমেশন এন্ড ম্যাস মিডিয়া (সিফডিয়া)