পরাবাস্তববাদ জীবনানন্দের কবিতায় নান্দনিকভাবে ফুটে ওঠে

জেসির আরাফাত : পরাবাস্তববাদ জীবনানন্দের কবিতায় নান্দনিকভাবে ফুটে ওঠেছে। বহু কবিতায় তিনি পুনর্জন্মের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। নশ্বর এই পৃথিবীতে বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন। কখনো শঙ্খচিল-শালিক হয়ে, কখনো হতে চেয়েছেন হাঁস। ক্লান্ত প্রাণের কবি জগতের সকল উপাদানের সাথে নিজেকে গেঁথে দেখিয়েছেন। এমনকি নিজেকে কল্পনা করেছেন একটি কমলার সাথেও। ‘কমলালেবু’ শিরোনামে তাই বলেছিলেন :

“একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব

আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?

আবার যেন ফিরে আসি

কোনো এক শীতের রাতে

একটি হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে

কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।”

সেই পরিচিত মুমূর্ষুজনের কথা কি নিজেকে ভেবে বলেছিলেন? ট্রাম দুর্ঘটনার পর নয়দিনের মতো হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন কি নিজের বিছানার পাশে নিজেকে কমলালেবুর রূপে দেখেছিলেন?

এবার একটা গল্প বলি। শীতের রাতের নয়; শীতের সকালের। বছর দুয়েক আগের ঘটনা। কনকনে এক শীতের সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। কুয়াশার ঘনত্ব এতো বেশি ছিল যে দুই হাত দূরের কিছুও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। এমন পরিবেশে সকালে হাঁটতে দারুণ লাগে। সময়ের সাথে সাথে একটা দুইটা করে সূর্যরশ্মি কুয়াশা ভেদ করে আসে। এমন একটি দিনে একাই হাঁটতে বের হয়েছিলাম।

তখন সকাল-বিকাল জীবনানন্দ পাঠ করতাম। ভদ্রলোকের কবিতার সাথে তখন নিজের যোগসূত্র পেতে শুরু করি। একটা সময় জীবনানন্দ ছিলেন আমার চরম অপছন্দের একজন কবি। সেই অবস্থান থেকে কিভাবে পছন্দের সারির শীর্ষে উঠে এলেন সেই গল্প অন্য কোনোদিন বলব। তখন জীবনানন্দ পাঠ করতে করতে তাঁর একটা প্রভাব আমার কলমে আসতে শুরু করে।

“আমি তারে পারি না এড়াতে,

সে আমার হাত রাখে হাতে।”

‘বোধ’ কবিতার এই কথাতেই যেন তখন নিজের কলমের পরিচয় পাই। ‘মাথার ভেতর এক বোধ কাজ করে’ বলে তখন এই নতুন বোধ কাজ করা শুরু করে।

সেদিন সকালেও নির্জন রাস্তায় হাঁটার সময় নির্জনতম কবির বোধ ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। তাঁর বিভিন্ন বেশে ফিরে আসবার কথা ভাবছিলাম। বিশেষ করে কমলালেবু হয়ে প্রত্যাবর্তনের কথা। তখন হঠাৎ মনে হলো মূর্তমান কিছু হয়েই কেন ফিরতে হবে। তিনি তো ফিরতে পারেন কোনো চেতনা হয়ে। তাঁর চেতনা অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত হওয়া তো অসম্ভব কিছু নয়। অসম্ভব নয় বলেই তো আমি টুকটাক যা লিখা শুরু করেছিলাম সেখানে দাশবাবুকে জোর করে হলেও টেনে আনতাম। তবে কি মাথার ভেতর যে বোধ জন্ম লয়, আমার মাথার ভেতর যে বোধ জন্ম লয়েছে সেটি তাঁর চেতনা হতে? তবে কি তিনি যে বারবার ফিরে আসার কথা বলেছিলেন, তিনি ফিরে এসেছেন? ফিরে আসলে তো তা জানান দিতে হবে। সকলকে বলতে হবে কমলালেবু ফিরে এসেছেন। সেই হিম সকালে এমন ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতেই কমলালেবুর সাথে কিছু শব্দ জুড়ে দিয়েছিলাম। আর নির্জনতম রাস্তায় একাই উচ্চারণ করেছিলাম :

“কুয়াশা নেমে এসেছে ভূতলে

এই কুয়াশার চাদর ছিন্ন করে ছুটে চলেছি—

পৃথিবীর পথে;

আমি এক কমলালেবু,

আবার এসেছি শীতের সকালে

ছুটে চলেছি পৃথিবীর পথে।”

শেয়ার করুন