বায়োপিক ( চার)
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:৪৫ মিনিটজুয়েল সাদত :
লেখা বন্ধ করলে চাপ বাড়ে। অনেকেই জানেন, আগের সুন্দর দিনগুলো কেমন ছিল। অনেক মায়াময় ও অধিকারের সময় ছিল। অধিকার মানে, পুরো পাড়া মহল্লাই অভিভাবক হিসাবে দায়িত্ব নিত। কেউ নষ্ট হয়ে যাবে, কেউ বাজে লোকের সাথে চলাফেরা করবে, তা ছিল অসম্ভব। আমিও এরকম একটা সমাজে বড় হয়েছি। আমাকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করেন মালনীছড়া চা বাগানের মরহুম আব্দুল মালিক চাচা ( বন্ধু রিপনের আব্বা)। চাচাই আমাকে স্কুলের গন্ডিতে পৌছালেন। আব্বা র সময় ছিল না। আবার চাচা আজ নেই। চাচার কথা একটু বলে নেই। চাচার একটা বন্দুক ছিল, শিকার করতে পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝে সেই বন্ধুকটা আমরা দেখতাম। রিপনের বাসা ও আমার বাবা পাশাপাশি, রিপন ( রুহুল আলম চৌ) বাল্যবন্ধু, তিনদিনের বড় আমার। চাচা ও আব্বা সহকর্মী ছিলেন। রিপন ও আমার মধ্যে পড়াশুনার এক বিরাট প্রতিযোগীতা ছিল। এমনও হত রাতে রিপন যে রুমে পড়ত, সেটা আমার বাসা থেকে দেখা যেত, সেও আমার পড়ার রুম দেখত। এমনও হত সে পড়ার রুমের লাইট নিভালে আমি পড়া শেষ করতাম।
আজ এগুলো হাস্যকর শুনাবে। সে এক হলে আমি দুই রোল নাম্বার, আমি ২ রুলে গেলে সে তিন রুল নাম্বার। আমরা একবার প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গেলাম বটেশ্বর ক্যান্টনমেন্ট, আব্দার ভাই আমার গার্জিয়ান, রিপনকে নিয়ে গেলেন তার ভাই মিন্টু ভাই। আমার জীবনটা এরকমই। এইডেড স্কুলে ভর্তি হলাম একাই। আম্মা অনেক চেষ্টা করলেন সিলেট পাইলট স্কুলে ভর্তি করাতে। মালনীছড়া থেকে কতটা দুর সিলেট পাইলট স্কুল আজ ভাবলেই চমকে উঠি। তখন ভাল পড়াশুনার জন্য সেই স্কুলটা ভাল ছিল। পরে আমি একাই এইডেড স্কুলে গেলাম, আমাদের দিয়ে ১৯৮৫ সাকে সিক্স E. ক্লাস শুরু।
শহরের বড় চাপটা এইডেড স্কুল নিত। ৬ স্ট শ্রেনীতে ৫ টা ক্লাস। তখন কেউ ফাষ্ট ডিভিশন পেলে, লেটার পেলে তাকে আমরা ভাল করে দেখতাম।
রিপন বাপু ও আমি একসাথে স্কুলে যেতাম, অনেকটা হেটে অনেকটা রিস্কায়। মানু কাকা ২ টাকা দিলে রিস্কায় চড়তাম। তিনি তাই করতেন সব সময়।।
আবদুল মালিক চাচা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমার লেখা পড়তেন। পত্রিকা পড়তেন, আমি সিলেটের ডাকে লেখি। ২০০৭ সালে আমার একটা বই বের হল, আমেরিকার জীবন যাপন নিয়ে ” আমেরিকা : ডানা ভাঙ্গা স্বপ্ন ” আমেরিকা বিষয়ক একটি তথ্যবহুল বই। বইটি ৪৬০ পৃস্টার ইংরেজীতে আসছে শীঘ্রই। আমি বইটি চাচাকে দিলাম, চাচা বইটি পেয়ে সারারাত না ঘুমিয়ে পড়া শেষ করলেন।অসুস্থতায় ভুগছিলেন, তারপর রাত জেগে পড়লেন।। রিপন আমাকে বলল, আবার চাচাও বললেন, “এই বেটা তুর বইটা আমি এক রাতেই শেষ করেছি “। আমার কিযে আনন্দ, ভাষায় বলে বোঝাতে পারব না। আমার বইয়ের অনেক প্রশংসা করলেন। সেই বইটি আজও অনেকে আমেরিকা আসার আগে পড়ে আসেন।
চাচাকে আনন্দ দিতে পেরেছিলাম, এটাই সবচেয়ে স্বীকৃতি।।
চাচা, আমেরিকা আসেন নাই। তবে একটি ধারনা ছিল। আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
১৯৯০ সালে এস এস সির রেজাল্ট বের হল। অনেকের অভিভাবক রেজাল্ট দেখতে স্কুলে। আমি একাই। রেজাল্ট বোর্ডের সামনে অভিভাদের কি উচ্ছাস, আমার ভেতরটা একটা শুন্যতা। হ্যা, ভালভাবেই পাশ করলাম।। আব্বা ১৯৮৬ সালেই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আল্লাহর নিকট।।
তারপর কলেজ জীবন আমি এম সি কলেজে ভর্তি হলাম, রিপন মদন মোহন কলেজ।।
এম সি কলেজটাতে ভর্তি হলাম একা। কোন অভিভাবক নেই আমার।
আমাদের একটা গ্যাপ তৈরী হয়ে গেল। এইডেড হাই স্কুলের সেই বন্ধুদের আর এক হওয়া হল না। এরকমই হয়, আমাদের গ্রুপ টা ভেংগে গেল।। এম সি কলেজে গিয়ে ৩ মাসের মাথায় একটি সংগঠন দাড় করালাম, মুল উদ্দেশ্য ছিল এইডেড স্কুলের সব বন্ধুদের এক প্লাটফর্ম এ রাখা, পরে সেটা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য হই । সংগঠনটা ছিল “এগোব ‘ এ গ্রুপ অব বেনিফ্যাক্টর। আমি এগোব এর সভাপতি, আজকের ডাক্তার রাসেল সাধারন সম্পাদক, কানাডার নবারুন দে সহ সভাপতি ছিল। ১৯৯০ সাল, ৩৫২ টি সেরা ছেলে মেয়ে ভর্তি হয়েছে সারা সিলেট বিভাগের, তাদের মধ্যে ১৫০ জন আমাদের সংগঠনে ।
কি দাপট আমাদের, কলেজের ঘাস ও আমাদের কথা শুনত।
ক্যাম্পাসে এগোব একটি হ্যামিলনের বাশিওয়ালা টাইপের অবস্থা। এরই মধ্যে আমরা অনেকেই নানা ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়েছি
মিছিল করি দিনের পর দিন, কলেজে ও শহরে দিনরাত রাজনীতি, পার্টি অফিসে পড়ে থাকি।
আর বন্ধুরা ক্লাস করে, তারা ডাক্তার ইন্জিনিয়ার প্রফেসর, বিএসএস ক্যাডার হল। আমিও কিছু একটা হলাম।
তখন ১৯৯১ সালে আমরা চট্টগ্রামের ঘুর্নিঝড়ে সিলেট থেকে রিলিফ নিয়ে যাই। ৮ জনের দল নিয়ে যাই। সিলেটের প্যানেল মেয়র লিপন আমার সাথে ছিল চট্টগ্রাম এর দলে।
কলেজ জীবন অনেক রঙ্গিন ছিল।
১৯৯০ -১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতি করলাম দাপটের সাথে, কলেজ ও জেলায় ভাল জায়গা ছিল। ভাল বক্তাও ছিলাম। ছাত্র রাজনীতি করে ক্যারিয়ার নস্ট করলেও সিলেট বিভাগ আন্দোলন টায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ছিলাম সামনের সারিতে, এম সি কলেজের একাধিক অনার্স মাষ্টার্স কোর্স চালু করতে পেরেছিলাম।
সেই সময়টায় জীবনের বড় আনন্দ, বেদনা ও ক্যারিয়ার টায় চাপ পড়ে যায়। ছাত্র রাজনীতি, প্রেম বিরহ ক্যারিয়ার নষ্ট করে সবাই বলে, মনের দৃড়তা থাকলে ঘুরে দাড়ানো যায়। নব্বই পরবর্তী সনয়টায় আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা পুনরুদ্ধার ও শোষনহীন সমাজটার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। মানুষের মধ্যে জীবনের সমতা, বৈষম্যহীন সমাজটা আমাকে টানত।
১৯৯৩ সাল থেকে লেখালেখিতে মনোযোগী হয়ে পড়লাম, আজকের সিলেট নামের একটা স্থানীয় দৈনিক এ লিখতাম।
১৯৯৪ সালে এম সি কলেজের ছাত্রলীগের সম্মেলন এর পর স্বেচ্ছায় ছাত্ররাজনীতি থেকে বিদায় নিলাম। এটা অনেকেই মেনে না নিলেও আমি সেই সময়টায় সরে গেলাম। সাংবাদিকতায় সিরিয়াস হতে শুরু করলাম। সাংবাদিতা নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলাম, প্রচুর পড়াশুনা শুরু করলাম। এটা আমাকে টানত। সংবাদ পত্রিকা পড়েছিলাম কৈশর বেলায়।
১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ তিন সালের মধ্যেই আমি একটা ভাল জায়গা করে নিলাম সাংবাদিকতায়।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আনসার ভিডিপির সিলেট বিভাগীয় গণসংযোগ কর্মকর্তা হিসাবে ( সিলেট বিভাগ) এর দায়িত্ব পেলাম। পুরো সরকারী চাকুরী। রিটেন ভাইভা দিয়ে তুমুল প্রতিযোগীতার চাকুরী।
আমার যোগদান ডিপার্টমেন্ট পত্রিকায় ছবি সহ ছাপাল। আমার সিলেটের সাংবাদিক সমাজে একটা ভাল অবস্থান তৈরী হল। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয় নি। তারপর আহমেদ নুর ভাইয়ের সাথে ভোরের কাগজ / প্রথম আলো এ ছিলাম। তারপর বিচিত্রাতে।
এম সি কলেজ থেকে বের হয়ে ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে সিলেট ল কলেজে ভর্তি হলাম। আইন পেশায় আর যাওয়া হল না সরকারী চাকুরীর ব্যাস্ততার কারনে।
আনসার ভিডিপির চাকুরীটায় নানা জেলা উপজেলায় যেতে হত। ভাল ট্রেইনার ছিলাম সংগঠনের। হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও সিলেটের দায়িত্ব পালন করতাম । বেতন, রেশন ও সব সুবিধা ছিল।
সততার সাথে সাড়ে চার বছর ছিলাম ডিপার্টমেন্ট এ। বিদায় সম্বর্ধনায় সবাই খুব কেদেছিল।।আমিও এই কম সুবিধাভোগী ডিপার্টমেন্ট এর মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম।।
চলবে /
লেখক সাংবাদিক
আমেরিকা প্রবাসী।