আজ ২১ আগস্ট । গ্রেনেড হামলার ১৯ বছর আজও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০২৩, ২:১০ মিনিট‘বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ পর দেখি ভয়াবহ অবস্থা। মনে হলো, কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে চলে আসছি। মানুষ এত নৃশংস হতে পারে! বহু রক্তাক্ত মানুষ জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করছিল। আমার খুব অস্বস্তি হতে থাকে; চোখে পানি চলে আসে।’ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পরবর্তী সময়ের বর্ণনা এভাবেই দেন কাপড় ব্যবসায়ী খবির হোসেন মিঠু।
সেদিন তিনি মঞ্চের অদূরে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে ছিলেন। সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছিলেন সমাবেশের একাংশ। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘আমি তখন পানি খাচ্ছিলাম। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) বক্তব্য চলছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে চারপাশ কেঁপে ওঠে। আমার মুখ থেকে পানি বেরিয়ে আসে। ঘটনা বোঝার আগেই লোকজনের ছোটাছুটি। আরও বিস্ফোরণের শব্দ পাই। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আমি দোকান থেকে বেরিয়ে সামনে এসে দেখি ভয়ংকর এসব দৃশ্য।’
১৯ বছর আগের সেই মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন সমাবেশে উপস্থিত আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক। এ ছাড়া আশপাশের ব্যবসায়ী, দোকান কর্মচারী, সাধারণ মানুষও দেখেছিলেন সেদিনের বীভৎসতা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ফুটপাতের কাপড় ব্যবসায়ী ৬৫ বছর বয়সী মো. মহিউদ্দিন জানান, প্রথমে প্রচণ্ড শব্দে পরপর দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তে মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। তিনি ভয়ে দ্রুত দোকানের মালপত্র পাশের মার্কেটে সরিয়ে নেন। দেখতে পান, অনেক মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানকে চিনতে পারেন।
সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ ব্যবসায়ী বা দোকান কর্মচারী আর কে কে আছেন– মহিউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখন দোকানপাট কম ছিল। তাদের অনেকেই এখন নেই; কেউ মারাও গেছেন। পুরোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সৌদিয়া, চমক ও সানমুন টেইলার্স রয়েছে। সৌদিয়ায় পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের আজীবন সদস্য মিঠুকে। তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমি অনেক দিন ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠতাম।’
আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের উল্টো দিকের গলিতে ‘লাক্সারি’ নামে একটি কাপড়ের দোকানের সেলস এক্সিকিউটিভ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঘটনার কিছুক্ষণ আগে আমি একবার সমাবেশস্থল থেকে ঘুরে আসি। তখন মঞ্চে শেখ হাসিনা ছাড়াও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মোহাম্মদ হানিফসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েক নেতা ছিলেন। অনেক লোক হয়েছিল। আমাদের গলিতেও লোক দাঁড়িয়ে ছিল। এর মধ্যে আসরের নামাজের সময় হওয়ায় আমি রমনা ভবনে নামাজ পড়তে যাই। নামাজ শেষে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, তখনই পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ। ভবন কেঁপে উঠল। ভয় পেয়ে আমি আবার ভবনের তৃতীয় তলায় ড্রেস কিং টেইলার্সে উঠে যাই। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি, নিচে লন্ডভন্ড অবস্থা। রক্তে রাস্তা ভিজে গেছে। এর মধ্যে তৃতীয় তলার সিঁড়ির কাছে আহত একজনকে পড়ে থাকতে দেখি। তাঁর গায়ে পাঞ্জাবি থাকলেও নিচের অংশে কিছু ছিল না। আমাদের গলির মুখেই একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পড়ে ছিল। সেদিন দোকান খোলা রেখেই আমরা চলে গিয়েছিলাম।’
পেট্রোল পাম্প (রমনা ফিলিং স্টেশন) গলির একটি উপগলির ভেতরের চা দোকানি বিল্লাল জানান, ঘটনার দিন তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। তাই দোকান খোলেননি।
ডিপার্টমেন্টাল স্টোর রাজ্জাকসের বিক্রয়কর্মী জাকির হোসেন জানান, ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ ছিল তাদের দোকানের সামনেই। মঞ্চে বক্তৃতা চলছিল, আর তিনি দোকানের ভেতর বসে ঝিমুচ্ছিলেন। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দে চমকে ওঠেন। প্রথমে আত্মরক্ষার অংশ হিসেবে তিনি ও দোকানে থাকা সবাই মেঝেতে বসে বা শুয়ে পড়েন। পরপর বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। মানুষের চিৎকার ও ছোটাছুটির আওয়াজ পান। দুই-তিন মিনিট পর বেরিয়ে দেখেন, দোকানের সামনের ফুটপাতে রক্তাক্ত এক নারী কাতরাচ্ছেন। পাশেই বাটা শোরুমের সামনে পড়ে ছিলেন আহত চার-পাঁচজন। ট্রাকের পাশে পড়ে ছিল তিনজনের নিথর দেহ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দোকানের বাঁয়ে ২৬ নম্বর ভবনের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন আদা চাচা (ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য রফিকুল ইসলাম)। আমাদের মালিকের আরেকটি দোকান ছিল রাস্তার উল্টো পাশে। সেখানে যাওয়ার সময় দেখি, পেট্রোল পাম্প গলির মুখে সেন্টু ভাইয়ের (আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক মোশতাক আহমেদ সেন্টু) ছিন্নভিন্ন দেহ। আহত নাছিম সাহেবকে (আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম) ধরে হাসপাতালে নিয়ে যান মুড়ি বিক্রেতা কিরণ।’
রমনা ভবন মার্কেটের নিচতলার দোকান হাবিব ট্রেডার্স সেই সময়ও ছিল। এটির মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর শত শত আহত মানুষ রাস্তায় পড়ে ছিল। দৃশ্যটা এমন ভয়াবহ যে, আমি জীবনে ভুলতে পারব না। সেদিন বাসায় গিয়ে আমি অনেকক্ষণ কেঁদেছি। বারবার মনে হচ্ছিল– এটা আমি কী দেখলাম! ওই ঘটনার পর সপ্তাহখানেক আমি কিছু খেতে পারিনি।’
রমনা ভবনের নিচতলায় আরেকটি পুরোনো দোকান নিউ মাদারীপুর বস্ত্র বিতান। এটির ব্যবস্থাপক হিরন বিশ্বাস তখন ছিলেন ২৩ বছরের যুবক। তিনি বলেন, ‘দোকানে বসে সামনের দেয়ালে লাগানো বড় আয়নায় মঞ্চ ও সমাবেশের ছবি দেখছিলাম। হঠাৎ স্টেডিয়ামের ওদিক থেকে বোমা ফাটার মতো আওয়াজ পাই। এর পর আরও কয়েকবার বিস্ফোরণ। কী হচ্ছে তা বুঝতে পারছিলাম না। নিরাপত্তার জন্য দোকানের কলাপসিবল গেট লাগিয়ে দিই। কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর দোকান থেকে বের হয়ে দেখি, সামনেই অবিস্ফোরিত একটি গ্রেনেড পড়ে আছে। এক পাশে মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী শাহিদা তারেক দীপ্তির গাড়ি আগুনে পুড়ছিল।’
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ১৮ নম্বর দোকান ‘নিউ পূর্ণিমা স্ন্যাক বার’। বিস্ফোরণের সময় ওই দোকানে বসে ছিলেন শেখ ইমরান। তখন তিনি ছিলেন নিতান্তই কিশোর। তিনি বলছিলেন, ‘পুরো দোকান ভরে গিয়েছিল ধোঁয়ায়। এর মধ্যে বাইরে থেকে লোকজনের চিৎকার, আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। কয়েকজন চিৎকার করে বলছিলেন– নেত্রীর কী হলো, নেত্রীর কী হলো? একটু পর কেউ আশ্বস্ত করলেন– নেত্রী ঠিক আছেন।’
সে সময়কার কোনো কোনো দোকানকর্মী এখন নিজেই মালিক। রমনা ভবনের নিচতলায় এ হোসেন ফেব্রিকস নামে একটি দোকানের কর্মী ছিলেন জহির রায়হান। এখন তিনি সলিমাবাদ ভবনের নিচতলায় নিউ রেমন্ড গোল্ড কালেকশন নামে একটি দোকান দিয়েছেন। ৬৯ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর পুলিশ মার্কেটের ভেতর ঢুকে সেখানে আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে পেটাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দিই। পরে বের হয়ে দেখি, পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়ছে। ঢাকা মেডিকেলের ডোমঘরে (মর্গ) গিয়ে দেখি লাশ আর লাশ।’
জহিরের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার নাজমুল হাসান জানান, তখন তিনি রমনা ভবনের মাঝামাঝি নিউ অনামিকা ফেব্রিকস নামে একটি দোকানের কর্মী ছিলেন। তাঁর বর্ণনায়ও সেদিনের বিস্ফোরণের ভয়াবহতার চিত্র উঠে আসে। পরে তিনি পেট্রোল পাম্পের গলি দিয়ে বের হয়ে ওয়ারীর বাসায় চলে যান।