হুমায়ূন আহমেদের সাথে এক স্বর্ণালী সন্ধ্যা
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০২৩, ৭:০৩ মিনিটআবুসাঈদ আনসারী :
তখন আমার নিতান্তই অল্প বয়স। কবিতা আবৃত্তি, লেখা, গল্প- উপন্যাস পড়া নিয়ে সময় কাটানোর বয়স। একবার আমরা বই মেলা করলাম। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে। হুমায়ূন আহমেদ সিলেটে আসলেন। আম্বরখানার হোটেল পলাশে উঠলেন।
সন্ধ্যায় আমরা সুলেমান হলে তাঁকে নিয়ে বসলাম। আমি তাঁর বইয়ের একজন একনিষ্ট পাঠক তখন। শরৎচন্দ্রের গল্পের মতো তাঁর গল্প ও এক দীর্ঘশ্বাসে পড়ে ফেলতাম। তাঁর গল্পের বিভিন্ন চরিত্র, যেমন, মিসির আলী, বাকের হিমু- আমাকে বিমোহিত করতো।
সেদিন তিনি শাদা পানজাবী পরে আসলেন। বোতাম ছিঁড়া। বক্তৃতার প্রথমেই তিনি আমাদেরকে বললেন, ‘এটা কেনো স্টাইল না, এখানে আসার আগে পানজাবী পরতে যেয়ে হঠাৎ বোতাম ছিঁড়ে গেলো।’ যদিও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।’ কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তা পারতেন। সহজ কথা সহজেই বলতেন এবং লেখতেন। সহজেই পাঠককে আকৃষ্ট করার এক অসাধারণ প্রতিভা তাঁর মধ্যে ছিলো।
আমরা তাঁকে প্রশ্ন করলাম- ‘আপনার লেখা বেশ সাদামাঠা, কোনো গভীরতা মেপে পাওয়া যায় না!’ তিনি বললেন, ‘লেখার গভীরতা মাপার কি কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে? হলে জানাবেন, যতটুকু গভীর হলে আপনাদের হয় ততোটা গভীর করে মেপে আপনাদের জন্য লেখবো।’ আমরা তাঁর কথা শুনে হাসলাম।
হুমায়ূন আহমেদ যদিও Chemistry এর মানুষ, আমেরিকার North Dakota State University of Agriculture and Applied Science থেকে তিনি পিএইচডি ও করেছেন এ বিষয়ের উপর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময়ে আমার বড়ো ভাবী ড. জাহেদার কলিগ ছিলেন। সাহিত্যের ছাত্র না হয়েও তাঁর সাহিত্যে অগাধ দখল আমাকে inspired করতো। তিনি যেভাবে Shakespeare, Shelly, Robert Frost, Maxim Gorky সহ অনেক authors কে তাঁর লেখায় নিয়ে এসেছেন, তা অবশ্যই outstanding.
তবে তাঁর সাধারণ ভাবে লেখা উপন্যাসকে অনেকে মেনে নিতে পারতেন না। ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর উপন্যাসকে অপন্যাস বলে আখ্যায়িত করতেন। আজকাল অনেকেই Honorary doctorate পেলে নামের আগে Dr খুব স্বাধ করে লেখেন। আবার অনেকে পিএইচডি করেছেন এক বিষয়ে আর practice করছেন অন্য বিষয়ে তবু ড. লেখা বাদ দেন না। হুমায়ূন কখনো ড. ব্যবহার করেননি। যেহেতু সাহিত্যের উপর তাঁর পিএইচডির থিসিস ছিলো না।
সে যাই হোক, কিছু উক্তির তিনি জন্ম দিয়েছিলেন, যা খুব অসাধারণ ছিলো। যেমন তিনি বলেছেন, “ সাধারন হওয়াটা একটা অসাধারন বিষয়, সবাই সাধারন হতে পারে না।”
ঐদিন সন্ধ্যায় তিনি আরেকটি কথা সম্ভবত এভাবে বলেছিলেন, “প্রতিটা মানুষের জীবনে কষ্ট আছে শুধু তা প্রকাশ করার পদ্ধতি ভিন্ন। নির্বোধরা প্রকাশ করে চোখের পানি দিয়ে আর বুদ্ধিমানরা প্রকাশ করে মৃদু হাসি দিয়ে। ”
আমাদের অনেককে তিনি পড়ার জন্য তাগিদ দিয়েছিলেন। তিনি তখনো দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। তাঁর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। স্ত্রী গুলতেকিন খান কে নিয়ে এসেছিলেন যিনি ছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর নাতনী।
অনেকক্ষন আমাদের কথাবার্তা চললো। রাজনীতি নিয়ে তিনি কোনো আলাপ করতে চাননি। তবে তিনিই প্রথম কোনো লেখক যিনি একজন হুজুরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিয়ে আসেন তাঁর লেখায়। না হলে দাঁড়ি -টুপি পরা লোককে সব সময় রাজাকার হিসেবেই দেখা যায় বাংলা নাটক- সিনেমাতে।Tradition কে তিনি break করতে পারতেন।
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা কথাসাহিত্যে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী। স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ভাষায়, ‘হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে গেছে।’
তাঁকে আমরা প্রশ্ন করলাম- ‘আপনি তো সব কিছু করছেন, অভিনয় কেনো করেন না?’ তিনি Shakespeare থেকে একটি quote করলেন-
“All the world’s a stage,
And all the men and women merely players.”
তিনি উপলব্ধি করলেন মুহাম্মাদ (স.) আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। একমাত্র অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, তাঁর জীবনী নিয়ে তিনি লেখা শুরু করলেন। নাম দিলেন – নবীজী। তা তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
আমার দুলাভাই বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক Salim Awal ছবিতে হুমায়ূনের পাশে রয়েছেন, বেশি না একটু মোটা মানুষ, বাবরি চুল, কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, পরিচয় দেবার জন্য বললাম আর কি। তাঁর নেতৃত্বে ক’জন মিলে অনেক সময় সেখানে কাটালাম। এই ছবিতে কিন্তু আমি নেই। কেউ আবার অন্য মানুষকে আনসারী বলে চালিয়ে দেবেন না!
সেই স্বর্ণালী সন্ধ্যায় যারা ছিলেন তারা জানেন হুমায়ূন আমাদেরকে কতো আপন করে নিয়েছিলেন। দোষে গুনে মানুষ। তাঁর সাথে আমার অনেক মতানৈক্য আছে এবং থাকবে। কিন্তু একজন লেখক হিসেবে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা আছে এবং থাকবে।
পরম করুণাময় তাঁকে ক্ষমা করুন। তাঁকে ভালোবাসুন।
আমিন
আবুসাঈদ আনসারী
#জুলাই ০৯, ২০২৩॥ লন্ডন, ইংল্যান্ড ॥