আমরা যখন কোনো গল্পের বই পড়ি তখন আমাদের পুর্ণ মনোযোগ গল্পের কাহিনীতে নিবিষ্ট থাকে । গল্প খুব ইন্টারেস্টিং হলে পড়ার সময় আশপাশে কী ঘটছে অনেক সময় খেয়ালই থাকেনা। এর কারণ তখন চিন্তার জগতে শুধু গল্পের কাহিনীটিই ঘুরপাক খায়।

তেমনি কুরআনের কোনো গাল্পিক সুরা যখন আমরা অর্থ বুঝে পড়তে পারি তখন আমাদের মনোযোগ কুরআনের প্রতিই নিবিষ্ট থাকে। আর যখন অর্থ না বুঝে শুধু তেলাওয়াত করি কিংবা ইমামের পেছনে কুরআন তেলাওয়াত শুনি তখন নামাজের ভেতরে মনোনিবেশ করতে পারিনা । দুই রাকাত পরপর শুধু গণতে থাকি আর কত রাকাত বাকি আছে। মনে হয় নামাজ শেষ হচ্ছে না কেন । বিশেষ করে তারাবির বিশ রাকাত নামাজ শুরু করার পর গণতে থাকি আর কত রাকাত বাকি আছে। অনেক সময় কত রাকাত পড়লাম সেই হিশাবটাও রাখতে পারিনা। পাশের মুসল্লির কাছে কানে-কানে জানতে চাই, কত রাকাত চলছে। কত রাকাত বাকি আছে। এর একমাত্র কারণ কুরআনের অর্থ না বুঝা। গল্পের ভেতরে প্রবেশের অক্ষমতা ।

আর তাই নামাজে দাঁড়ানোর পর মন এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে থাকে । দুনিয়াবী নানা বিষয় মাথায় এসে বাসা বাঁধে। নামাজে দাঁড়ানোর আগে কোনো একটি জিনিস খুঁজে পাচ্ছিলামনা, নামাজে দাঁড়ানোর পর সে জিনিসটি বারবার মনে পড়ছে । কোথায় রেখেছি- সেকথা মনেও পড়ে যায় । অনেক সময় নামাজ শেষ করে ওই স্থানে খুঁজেও পাওয়া যায়। তাছাড়া কে ফোন করেছিলো, কার ফোন রিটার্ণ করতে পারিনি সেটাও নামাজে দাঁড়ালেই মনে পড়ে।

শনিবার রাতে স্থানীয় তাসনিম জামে মসজিদে তারাবিহ পড়ছিলাম। ছুটির দিনে ইমামের পেছনে ২০ রাকাত শেষ করার চেষ্টা করি। গতকাল ইমাম সাহেব শেষ চার রাকাতে সুরা ইউসুফ তেলাওয়াত করছিলেন । সুরাটি আমার খুবই প্রিয়। কারণ এটি পুর্ণ গল্প-নির্ভর একটি সুরা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পের বাইরে আর কিছু নেই। ১১১টি আয়াত । সুরাটিকে আল্লাহ তায়ালা 'আহসানাল ক্বাসাস' বা 'সুন্দরতম কাহিনী' বলে অভিহিত করেছেন । আসলেও এটি একটি শ্রেষ্ঠ গল্প। নবী ইব্রাহিম (আঃ) এর নাতি ও হযরত ইয়াকুব নবীর পুত্র ইউসুফ নবীর জীবন

কাহিনী।

বাল্য বয়সে স্বপ্নে এগারোটি তারকা ও চন্দ্র-সুর্য তাঁকে সেজদা করতে দেখা, দশ সৎ ভাইয়ের হাতে কুপে নিক্ষেপ হওয়া, সেখান থেকে ব্যবসায়ী কাফেলার তুলে নেওয়া, মিশরে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া, মিশরের প্রধান সেনাপতি পুথিফারের ঘরে বড় হওয়া, তাঁর স্ত্রী বানু জুলেখার কুনজরে পড়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়ে দীর্ঘ কারাবাস, রাজা আমেন হুতেফের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে জেল থেকে মুক্তি লাভ, তাঁর উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়া, কৃষিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে দেশকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করা এবং ৩০ বছর পর পিতা ইয়াকুব নবীর সান্নিধ্য লাভ-এই কাহিনীটি অত্যন্ত চমৎকারভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন আল্লাহ তায়ালা। এটি এমন এক চমৎকার কাহিনী যা পড়লে কিংবা শুনলে মনোযোগ অন্য দিকে নিবিষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই।

আরবী কিছু শব্দের অর্থ জানা থাকায় এবং গল্পটি একাধিকবার পড়ায় ইমাম সাহেব পড়ার সময় অর্থ পুরোপুরিই বুঝতে পারি । তখন ইমাম সাহেবের তেলাওয়াত শুনতে শুনতে আমি গল্পের মধ্যেই ডুবে যাই। মনের আয়নায় দেখতে পাই- কীভাবে ইউসুফকে কুপের মধ্যে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, আবার কুপের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ব্যবসায়ী কাফেলা যখন বালতি দিয়ে পানি তুলছেন তখন পানির পরিবর্তে বালতির মধ্যে ওঠে আসছে অপরূপ সুন্দর একটি বালক ।

আমি ইমাম সাহেবের কণ্ঠে তেলাওয়াত শুনছি। অর্থ অনুধাবন করছি আর মনের আয়নায় যেন সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মিশরে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটি দেখছি । আমার মনেই ছিলোনা কত রাকাত নামাজ চলছিলো। এক সময় ইমাম সাহেব সালাম ফিরিয়ে হাত তুলে মোনাজাত শুরু করলে বুঝতে পারলাম তারাবিহ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে হলো, নামাজ শেষ হলেও গল্পটা শেষ হয়নি । কারণ ইমাম সাহেব শুধু মিশরের রাজার ৭টি রুগ্ন গরু কর্তৃক সাতটি মোটাতাজা গরুকে গিলে ফেলার স্বপ্ন দেখা পর্যন্ত এসেছেন। এখনও গল্পটির অনেক বাকি আছে। তাহলে গল্প শেষ হলোনা মানে সুরা ইউসুফ আজ শেষ হয়নি। নামাজ শেষে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন- নাহ, শেষ হয়নি।

আসলে আমরা অর্থ বুঝিনা বলেই নামাজের ভেতরে মনোনিবেশ করতে পারিনা। অথচ কুরআন বুঝা খুব কঠিন নয় । কুরআনে শতশত শব্দ একাধিকার ব্যবহার হয়েছে । মাত্র কয়েকশ শব্দের অর্থ মুখস্থ করতে পারলে, আর কিছু গ্রামার (সরফ-নাহু) জানা থাকলে কুরআন বুঝা সহজ। বিশেষ করে গল্প-ভিত্তিক সুরাগুলো বুঝা খুবই সহজ। গল্পের কাহিনী কুরআন বুঝতে সহজ করে দেয়। আর কুরআনের এক চতুর্থাশই গল্প। সুন্দর সুন্দর কাহিনী । বিশেষ করে নবী রাসুলদের জীবন কাহিনী।

তাই আসুন, আরবী ভাষা শিখার চেষ্টা করি। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আমরা কুরআন পড়ি। রমজানে বিশ রাকাত তারাবিহ পড়ি। কিন্তু কী পড়ি জানিনা, বুঝিনা । বুঝিনা বলেই নামাজে মনোনিবেশ করতে পারিনা। সারাজীবনই নামাজ পড়লাম। নামাজে কুরআন তেলাওয়াত করলাম । তেলাওয়াত শুনলাম। কিন্তু কী পড়লাম, কী শুনলাম। কিছুই বুঝতে পারলামনা। এটা খুবই পরিতাপের বিষয়।

ছবি: ইউসুফ নবীকে কুপে ফেলার কাল্পনিক দৃশ্য