বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল :
১৭ নভেম্বর। বৃহস্পতিবার। বিলেত সফরের আটাশ দিন শেষ হয়ে গেল। সময় ঘনিয়ে আসছে। এক মাস সফরের পরিকল্পনা নিয়ে আসলেও মনে হচ্ছে আরো বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। বিভিন্ন স্থানে যেভাবে প্রিয়জনদের ভালোবাসায় স্নিগ্ধ হচ্ছি, তাতে এ ভালোবাসার আহবানকে কিছুতেই পেছনে ফেলে রাখা সম্ভব নয়। একজন বিখ্যাত লেখক বলেছেন, জীবন আমাকে যা দেয়, তা আনন্দচিত্তে গ্রহণ করি। জীবনের অপ্রাপ্তিকে কখনো নিজের চিন্তায় নিয়ে আসি নি। বরং সবসময় প্রাপ্তিকেই মনে করেছি, আমার সময়ের উপহার! লন্ডনে এসে তাই মনে হচ্ছে আমার!
বৃহস্পতিবারের সকাল ছিল অনন্যময়তায় ঘেরা। একটি ফুরফুরে মন নিয়ে খুব সকালেই বেরিয়ে পড়লাম লন্ডনের পথে প্রান্তরে। অবশ্য আমার লক্ষ্য ছিল প্রিয় একজন ভাতিজার সঙ্গে দেখা করা। ভাতিজা এবং ভাতিজা বউয়ের আমন্ত্রণেই মূলত সকালে বাসা থেকে তাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। ভাতিজার নাম সৈয়দ আলী আফজাল আব্দুল্লাহ জামী। তিনি একজন ব্যারিস্টার। লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটিতে তিনি একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। শুধু তাই, নিজের মেধা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা এবং বিচক্ষণতার মাধ্যমে বার্মিংহামের কোর্টে একজন বিচারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর আরেকটি পরিচয় রয়েছে, তিনি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কবি ও সংগঠক লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ আলী আহমদের সন্তান! ভাতিজার আমন্ত্রণে চলে যাই তাঁর বাসায়। সেখানেই সম্পন্ন করি ব্রেকফাস্ট। স্বদেশের বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতা হয়। তাঁর স্ত্রীও বেশ আন্তরিকতা প্রদর্শন করেন। দারুণ আতিথেয়তা ছিল স্মরণীয়। ভাতিজা বউ সিলেটের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। ভাতিজা এবং ভাতিজা বউ যেভাবে আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছেন, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। তাঁদের সঙ্গে একটি প্রাণবন্ত আড্ডা শেষে আন্তরিকতাপূর্ণ বিদায় গ্রহণ করি। আমার সঙ্গে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ সঙ্গ দিয়েছিলেন আমার প্রিয় ভাই এজাজ।
ভাতিজা ব্যারিস্টার জামীর বাসা থেকে চলে আসার পর ভাই এজাজের সঙ্গে লন্ডনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ালাম। এরই মধ্যে মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়ে গেলে ইস্ট লন্ডন মসজিদের পাশে অবস্থিত ব্রিকলেনের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিই। ব্রিকলেনের এই অঞ্চলটিতে অসংখ্য বাঙালি বসবাস করেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সিলেটের অধিবাসী। এছাড়া এই অঞ্চলে কয়েকটি বাঙালি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। যেখানে বাঙালি খাবারের আয়োজনটা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে থাকে! এমন একটি রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলাই যায়! মধ্যাহ্নভোজ শেষে একটু বিশ্রাম নিই।
বিকেলে বসে বিশ্রাম নেওয়ার প্রাক্কালেই লন্ডনের বিশিষ্ট কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব লুকমান উদ্দিন ভাই নিজস্ব বাসায় চায়ের আমন্ত্রণ দেন। লুকমান ভাই এ অঞ্চলে খুবই পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তাই তো এমন প্রিয়জনের দাওয়াতকে অগ্রাহ্য করার সাহস নেই! এজন্য প্রিয় ভাই এজাজকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাই লুকমান ভাইয়ের বাসায়। সেখানে আমার সাথে দেখা করতে আসেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও গবেষক আবদুল আউয়াল হেলাল ভাই ও লেখক-প্রকাশক মুকিত ভাইকে! তাঁদের সঙ্গে অনেক সময় খোশগল্প করি। দেশ ও প্রবাসের বিভিন্ন বিবিধ বিষয়ে আলাপচারিতা হয়। তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মাগরিবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। নামাজের আজান হলে স্থানীয় একটি মসজিদে নামাজ পড়ে নিলাম। সন্ধ্যার পরই আমাদের লক্ষ্য রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিসের মতবিনিময় ও সাহিত্য আড্ডা। তাই তো নির্দিষ্ট সময়ে চলে গেলাম সেখানে। সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় পূর্ব লন্ডনের ভ্যালেন্স রোডস্থ কমিউনিটি হলে এই মতবিনিময় সভা ও সাহিত্য আড্ডা অনুষ্ঠিত হয়। এই মতবিনিময় সভা ও সাহিত্য আড্ডায় লন্ডনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন। কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব এই মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করেন। মতবিনিময় সভা অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ হয়েছিল। এ মতবিনিময় সভার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আমার যুক্তরাজ্য সফর। সত্যিই ব্রিটেনের প্রাচীনতম সাহিত্য সংগঠন রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিশ ইউকের এমন আয়োজন আমাকে অভিভূত করে দিয়েছিল।
সংগঠনের সভাপতি কবি, ছড়াকার ও নাট্যকার কে এম আবু তাহের চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কবি শিহাবুজ্জামান কামালের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কামব্রিয়া কাউন্সিলের ভাইস চেয়ার (ডেপুটি স্পিকার) কাউন্সিলর আব্দুল হারিদ এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন ইউকের সাবেক সভাপতি ডা. মাহমুদুর রহমান মান্না ও হবিগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ আজিজ। সভায় কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন খান জামাল নুরুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুছ, লোকমান উদ্দিন, হাজী ফারুক মিয়া, আব্দুল মালিক কুটি, আলহাজ্ব নুর বক্স, ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন, অধ্যাপক আব্দুল হাই, কবি ও সাংবাদিক আবু সুফিয়ান চৌধুরী, সাংবাদিক আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল, কাউন্সিলর আবু তালহা চৌধুরী, ব্যাংকার আব্দুল আহাদ, আব্দুল আজিজ খান, মোঃ আব্দুল করিম প্রমুখ। স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন কবি শাহ এনায়েত করিম, কে এম আবু তাহের চৌধুরী, সৈয়দ রফিকুল ও সাজু মিয়া।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত অতিথিবৃন্দ যেভাবে পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের প্রকাশনা জগতে অবদান তুলে ধরেন, তাতে আমি সত্যিই অনুপ্রাণিত হয়েছি। এমন আন্তরিকতা ও ভালোবাসা কখনো ভুলার নয়। আমি সারাজীবন এমন গুণী মানুষদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো, যারা আমাকে একটি আলোকিত সময় উপহার দিয়েছেন। মতবিনিময় সভায় সাধারণ সম্পাদক শিহাবুজ্জামান কামাল সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। মতবিনিময় সভা প্রীতিভোজ ও দোয়ার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। দোয়া পরিচালনা করেন মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস। এমন একটি আয়োজন করার জন্য আমি রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিশ ইউকের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিশের নেতৃবৃন্দের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিই। ইতোমধ্যে গোলাপগঞ্জ সোশ্যাল এ্যান্ড কালচারাল ট্রাস্ট আমাকে একটি মতবিনিময় সভার দাওয়াত দিয়েছে। তাই তো সেই মতবিনিময় সভায় যোগদানের জন্য হোয়াইটচ্যাপেল এলাকায় চলে যাই। সেখানকার একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
গোলাপগঞ্জ সোশ্যাল এ্যান্ড কালচারাল ট্রাস্ট ব্রিটেনে গোলাপগঞ্জবাসীদের একটি প্রাণের সংগঠন। এ সংগঠন যেমন প্রবাসে অবস্থানরত গোলাপগঞ্জবাসীর কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে, তেমনই বৃহত্তর গোলাপগঞ্জবাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ সংগঠনের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়। মতবিনিময় সভায় গিয়ে আমার অনেক প্রিয়জনকে দেখতে পাই। যাদের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক দিনের। নির্দিষ্ট সময়েই শুরু হয় মতবিনিময় সভা। সংগঠনের সভাপতি আলহাজ্ব শামসুল হকের সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিছবাহ মাছুমের পরিচালনায় মতবিনিময় সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গোলাপগঞ্জ স্যোশাল এ্যান্ড কালচারাল ট্রাস্ট ইউকে’র সাধারণ সম্পাদক মোঃ দিলওয়ার হোসেন, বিশিষ্ট কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ও উপদেষ্টা লোকমান উদ্দিন, সাংবাদিক ও লেখক মো. আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল, গোলাপগঞ্জ হেল্পিং হ্যান্ডস ইউকে’র সাবেক সভাপতি তমিজুর রহমান রঞ্জু, জালালাবাদ এসোসিয়েশন ইউকে’র সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক জিলু, কোষাধ্যক্ষ মাসুদ আহমেদ জোয়ারদার, গোলাপগঞ্জ সোশ্যাল এ্যান্ড কালচারাল ট্রাস্ট ইউকে’র কালচারাল সেক্রেটারি কামাল উদ্দিন, উপদেষ্টা আব্দুল বারী নাছির, উপদেষ্টা আছাদ উদ্দিন প্রমুখ। সত্যিই এ মতবিনিময় গুণী মানুষদের দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছি। সভার শেষে নৈশভোজের আয়োজন ছিল আকর্ষণীয়। সংগঠনের নেতৃবৃন্দ যেভাবে পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের প্রকাশনা জগতে অবদান তুলে ধরেন, তাতে আমি আরো বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাঁদের অপরিসীম সম্মান ও ভালোবাসা আমার দায়বদ্ধতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁদের সকলের প্রতি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা সারাজীবনের। মতবিনিময় সভা শেষ হলে বাসায় চলে আসি।
রুমে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। মনে পড়ছে, সমস্ত দিনের ক্লান্তির রেখা। কিন্তু অপরিসীম আনন্দ আমার মনকে শীতল করে দিয়েছে। একটি কথা স্মরণ হওয়ায় মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেল--জীবন তোমার থেকে যা কিছু নিয়ে যাবে, তার থেকেও বেশি ফিরিয়ে দেবে। সত্যিই বিলেত সফরে এসে সেই ফিরিয়ে দেওয়াটা আমার মনকে জৈবনিক আনন্দে ভরিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বৃহস্পতিবারের স্নিগ্ধ সময় আমার সমস্ত দিনের ক্লান্তিকে গভীর ঘুমের আবেশে ঠেলে দিল! মানুষের ভালোবাসায় মিলে জীবনের পরম আনন্দ!
--------------------------------
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল
ইস্ট লন্ডন, যুক্তরাজ্য।