সাইক্লোন শীতকালীন কবিতা উৎসব-২০২৪
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৭:২০ মিনিটমোয়াজ আফসার
‘সাদা পাথর’ মিনি বাসটা মেইন রোড ছেড়ে ডান দিকে বাড়ির পথে টার্ন করতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। ওই পথ বেশ কিছুটা পেরুলে আমাদের গন্তব্য বারাকা পাওয়ার লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শিল্পপতি ফাহিম আহমদ চৌধুরীর বাড়ি বিয়ানীবাজার উপজেলার আলী নগর গ্রামে। গাড়ির ড্রাইভার দ্রুত নিচে নেমে ল্যান্ড সার্ভেয়ারের মতো পথের ভাও একটু পরখ করে এসে কিছুটা অপরাধীর সুরে বলে-আর আগুয়ানি যাইত নায়। প্রাইভেট কার,লাইটেসের মতো যানই কেবল চলতে পারে ওই পথ দিয়ে। পায়ে পায়ে যেতে হবে।
এই দুঃসংবাদে কোন কোন চেহারা বেশ মলিন হয়ে ওঠে। হেটে যেতে হবে। শহরে যারা থাকি অধিকাংশের হাটার বড় ভয়। অথচ জীবনের প্রয়োজনে হাটাটা যে কতটা অবশ্যম্ভাবী বুঝেও অলসতা জড়িয়ে রাখি। হাটার কথা শুনলেই কারো কারো হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থা হয়। আমি অনেকের মুখের দিকে তাকাই।গল্পকার সেলিম আউয়াল পত্নী আফিয়া সুলতানার বিমূঢ় মুখখানা দেখে আমার খুব মায়া হয়।
আমি গাঁয়ের অন্য দৃশ্যাবলীতে মনো:সংযোগ করার চেষ্টা করি।
ঈষাণ কোণে এমন দুর্ভোগের ছায়া কাটাতে আমাদের আজকের আয়োজনের কর্ণধার কবি সালেহ আহমদ খসরু সবাইকে ভরসা ঢেলে দিয়ে তাঁর হন্তদন্ত তালাশ শুরু হয় সিএনজি অটোরিকশার। কিন্তু দুর্দান্ত এক কবি কোনকিছুকে পরোয়া না করে অকুতোভয় সৈনিকের মতো হাটা শুরু করেন। তিনি কবি ইশরাক জাহান জেলি। হাটাতেই যেন তার আনন্দ। তা দেখে অনেকেই সাহসী হয়ে ওঠেন। কবি সেনুয়ারা আক্তার চিনু, কবি মাসুদা সিদ্দিকা রুহি, আমার জায়া ফাহমিদা চৌধুরী, লেখক তাসলিমা খানম বিথী সবাই বেশ আনন্দচিত্তে হাটাদের দলে যোগ দেন।আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে গাঁয়ের পথ ভাঙ্গা শুরু করি। হঠাৎ একসাথে এতো মানুষের আগমন গ্রামের লোকজনের ভেতর বেশ কৌতুহলের জন্ম দেয়।জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে তারা আমাদের দিকে তাকায়। ওদের উৎসুক চাওয়া চাওয়িতে বুঝা যায় আমরা কোন বিয়ের পয়গাম নিয়ে হয়তো কোন বাড়ির অতিথি। ওসব নিয়ে আমরা ভাবি না। হাটতে থাকি।
বিশ মিনিটের পথ। কিছুদূর হাটার পর পিচ রাস্তা শেষ হলে গাঁয়ের আঁকাবাঁকা বেওয়া নারীর অমসৃণ কোমরের মতো মেঠো পথ ধরে আমরা আগাই। যেতে যেতে দেখি বিরাট বিরাট খালি মাঠ। ধানের শীষ দোলানোর মতো হু হু বাতাস। কিছু দূর দূর দেখা যায় ছোট ছোট দ্বিপের মতো গাছগাছালি, ছালা-কাপড়ের বেড়া দিয়ে আব্রু করা কৃষকদের আবাস। কৃষক তার স্বপ্নের ফসল কেটে নিয়ে এখন নিশ্চিন্তে পরিবার নিয়ে সুখের দিন কাটায়।
‘তাড়াতাড়ি নিড়ানির স্তুপাকার জঞ্জাল সরিয়ে শস্যের শিল্পীরা এসে আলের ওপরে কড়া তামাক সাজালে।’
আল মাহমুদের কবিতার এই কড়া তামাক এখন আর তেমন কেউ সাজায় না, কৃষকেরা এখন ফিলটার টিপ দিয়ে নিকোটিন বাতাসে উড়ায়। আসলে বদলে গেছে সবকিছুই। আগের সেই গ্রাম এখন আর নেই।
আগে সকাল বেলা পুকুরপাড়ে মহিলাদের একটা ক্ষুদে পার্লামেন্ট বসতো যেটির নাম ছিলো ঘাটচর্চা। গ্রামের নারীরা এখানে বসে হাড়ির খবর, স্বামী-স্ত্রী, বৌ-শাশুড়ির সম্পর্ক, বিয়ে-শাদি, অভাব-অভিযোগ এগুলো নিয়ে আলোচনা হতো আর এখান থেকে নানাধরনের ঝড়গা-বিবাদেরও সৃষ্টি হতো। তবু সুন্দর ছিলো সেই সোনালি দিনগুলো।
‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না–
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।’
এই ঘাটচর্চা এখন আর হয় না। এগুলো হতো মূলত পুকুরের পানিতে ধোয়ামোছার কাজে নারীরা আসতেন বলে। এখন প্রায় প্রত্যেকের নিজস্ব পানির ব্যবস্থা থাকায় পুকুর ঘাটে আর আসতে হয় না।
সন্ধ্যার পর গ্রাম্য বাজারে বসতো পুরুষদের আড্ডা।গল্পগুজব হতো,গান বাজনা হতো,ঝগড়াঝাঁটিও হতো। এখনও পুরুষদের আড্ডা হয়। কিন্তু এখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আগের সেই পরিবেশকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিয়েছে।
দেউড়িতে দাঁড়িয়ে রমণীরা লুকিয়ে আমাদের দেখে। ভাবনায় তাদের কত খেলা খেল করে। আমাদের দৃষ্টি ওদিকপানে ছুটলেই ছায়ার মতো ওরা মিলিয়ে যায়। তাদের ঘরের আঙ্গিনায় পরিপাটি করে খড়ের গম্ভুজ আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে যেন খরাতাড়িত দিনে কৃষকের দু’হাত তুলে মহান রবের কাছে বৃষ্টির প্রার্থনা। হাটতে হাটতে অনেকদিন পর গোবরের গন্ধ আর খড়ের টিমোথি গন্ধ যেন গ্রাম বাংলার আসল পরিচয় আমাদেরকে জানান দেয়। বিশ- পঁচিশ মিনিটে আমরা চলে আসি আমাদের ঠিকানার কাছাকাছি।
প্লেনের জানালা দিয়ে যেমন নদ-নদী,পাহাড়-জঙ্গল দেখতে দেখতে হঠাৎ কোন শহরের দেখা মিলে তেমনি হঠাৎ করেই যেন দেখা দেয় গ্রামের ভেতর ছোট্ট একটি শহরের। খোলা গেট। কংক্রিট বিছানো বাড়ির রাস্তা। সে রাস্তায় আমরা পা রাখি। বিরাট এলাকা নিয়ে বাড়ি। বাড়ি তো নয় ছোটখাটো এক রিসোর্ট। গেট থেকে বাড়ি প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ। যেতে যেতে চোখে পড়ে বিরাট সাইজের জমজ পুকুর। পুকুর পার ঘিরে গাছগাছালির সারি। পুকুরের স্থির স্বচ্ছ কিশোরীর ত্বকের মতো মসৃণ পানিতে গাছের ছায়া পড়ে অভূতপূর্ব এক কম্বিনেশন, মনে হয় যেন কোন ঝানু শিল্পীর হাতে আঁকা ডিটেইল আর্টওয়ার্ক। গ্রামেই কেবল এই মন ভোলানো প্রাকৃতিক দৃশ্যের দেখা মেলে- অন্য কোথাও নয়! অজান্তেই হৃদয়ে গুঞ্জরিত হয়-
‘তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;’
আমরা হেটে যাই। যেতে যেতে শুনি গাছের ভেতর থেকে ভেসে আসে পাখিদের মুখরিত কলকাকলি। নীড়ে ফেরার উচ্ছ্বাস।
এবারকার আয়োজনটা বড় আচম্বিত। হঠাৎ করেই কবি সালেহ খসরু ভাইয়ের ফোন, তিনি একটা প্রস্তাব রাখবেন আমি যেন তাকে নিরাশ না করি। প্রস্তাবের আগেই তার নিঃশর্ত অঙ্গীকার দাবি আন্তর্জাতিক কোন ফোরামে কোন দেশের দুর্দান্ত কূটনীতিকের মতো। আমি খানিকটা ইতস্তত বোধ করলেও প্রোগ্রামের বিস্তারিত বর্ণনা শুনে বেশ মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায়। সে অনেকটা মালির সাজানো বাগান দেখার মতো। প্রলুব্ধ না হয়ে পারি না। শুরু হয় সফল করার তোড়জোড়। শহর থেকে দূরে –
‘শীতকালীন কবিতা উৎসব’ র ব্যানারে ২৯জানুয়ারি ২০২৪-এ শীতল হাওয়ার রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরে আমাদের যাত্রা।
উৎসব স্থলে পৌঁছতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। মাগরিবের সময় হয়ে এলে জামাতের সাথে আমরা নামাজ আদায় করি। ইমামতির দায়িত্ব কবি সাহিত্য সমালোচক বাছিত ইবনে হাবিবের। নামাজ শেষেই সবার ডাক পড়ে চা- চক্রে। চানাচুর, বিস্কিট, বাখরখানি আর গরম চা-য়ে সাজানো টেবিল। শীতের সন্ধ্যা আর ভ্রমণের ক্লান্তি মূহুর্তে বিদেয় নেয় চা’র উঞ্চতায়। কবি কামাল আহমদ আর বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সিলেটের সভাপতি আব্দুল বাতিন ফয়সল ব্যস্ত হয়ে যান ব্যানার টাঙ্গিয়ে মঞ্চ প্রস্তুতে। মিডিয়াকর্মী আফজাল হোসেন অনুষ্ঠান লাইভ করার জন্য পুরো প্রস্তুতি সম্পন্ন করে নেন।
গল্পকার সেলিম আউয়ালের সঞ্চালনায় শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। সাইক্লোনের ২৭৬ পর্ব। ‘ শীতকালীন কবিতা উৎসব ২০২৪’। জমজমাট এ উৎসবে সভাপতিত্ব করেন বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি অধ্যক্ষ কালাম আজাদ, সম্মানিত অতিথি বারাকা পাওয়ার লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সমাজসেবী ফাহিম আহমদ চৌধুরী আর বিশেষ অতিথি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত ডিরেক্টর কবি ডা: মো. মাশুকুর রহমান, সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ বশিরুদ্দিন, কলামিস্ট বেলাল আহমদ চৌধুরী, বাচিকশিল্পী কবি সালেহ আহমদ খসরু, শাবিপ্রবি’ র ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও সাহিত্য সাময়িকী আল ইসলাহ সম্পাদক আহমদ মাহবুব ফেরদৌস, শাইনি স্টেপস্ -এর প্রিন্সিপাল কবি সেনুয়ারা আক্তার চিনু,সাহিত্য সমালোচক বাছিত ইবনে হাবীব ও অনলাইন সিলেট টুডে’র সম্পাদক কবির য়াহমদ। আমরা আগত সব আভাজন করতালিতে গুণীজনদের স্বাগত জানাই। কণ্ঠশিল্পী মো. শামসুল ইসলাম খানের পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সূচনা হয়।
এরপর অনুভূতি প্রকাশ করে কবিতা-ছড়া পাঠ করেন ছড়াকার কামরুল আলম,সিলেট লেখিকা সংঘের সাধারণ সম্পাদক কবি ইশরাক জাহান জেলি, সুরমা নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্রের সাধারণ সম্পাদক মাসুদা সিদ্দিকা রুহী,লিটল ম্যাগ দো-আশ সম্পাদক কবি-সাংবাদিক লুৎফুর রহমান তোফায়েল,শিক্ষিকা আফিয়া সুলতানা, রন্ধন শিল্পী ফাহমিদা চৌধুরী, সাইক্লোনের সাহিত্য সম্পাদক তাসলিমা খানম বিথী, কণ্ঠশিল্পী মো. শামসুল ইসলাম খান, কণ্ঠশিল্পী বিমান বিহারী বিশ্বাস, কবি কামাল আহমদ, ছড়াকার মাজহারুল ইসলাম মেনন,প্রবীণ লেখক মকসুদ আহমদ লাল,তাপাদার জান্নাতুল জাহরা,আরমান আহমদ আফ্রিদি, উমের আহমদ চৌধুরী।
কবি কালাম আজাদ এখানে এসে তাঁর কাব্যিক স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, উচ্ছ্বসিত উল্লাসে ভেসেছেন। তিনি তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন –
কবিরা তীর্থ করো আমাদের গ্রামে
তোমাকে কসম দিই কবিতার নামে।।
আমাদের আজকের শীতকালীন কবিতা উৎসবটি যেন তাঁর সেই স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন।
আমার সবচে’ বেশি দাগ কাটে ষ্টেজে বসা ছোট্ট শিশু উমের চৌধুরীর বাবা ফাহিম চৌধুরীর বিনয়ে। তাঁর পাশে বসে তাঁরই ছোট্ট উমের। ওর হাতে মাইক্রোফোন দিয়ে কিছু বলার আহবান জানাচ্ছিলেন উপস্থাপক। সে কিছু বলে না। দর্শক সারি থেকে কেউ কেউ বলছিলেন- বাংলা মন খয় পার না। ইংরেজিতেউ খইলাও। আমি ফাহিম চৌধুরীর এক্সপ্রেশন দেখি। তিনি মনে হয় বেশ খানিকটা বিব্রত বোধ করছিলেন তখোন। বার বার বলছিলেন, পারে, পারে, বাংলা পারে। নিজের ভাষার প্রতি তার যে অনুভূতি, ভাষার প্রতি তার সম্মান, দায়িত্ববোধ এটা আমাদের অনুপ্রাণিত না করে পারে না। স্যালুট জানাই সেইসব মা-বাবাদের যারা ইংরেজির চে’ বাংলাকে প্রাধান্য দেন, বুকে আগলে রাখেন।
‘ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছে প্রাণ
ভুলিনি আমরা ভুলিনি আমরা’
জমে উঠা উৎসব কি করে ভাঙ্গি। তবু ভেঙ্গে দিতে হয়।
রাত অনেক। টেবিলে ডিনার রেডি। বিরিয়ানি , সাদা ভাত, কালিয়া,দই। সমস্ত টেবিল জুড়ে এখানে ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে খুব আমোদে আমরা রাতের খাবারের স্বাদ নিই। ফাহিম চৌধুরী নিজে খাবার পর্ব তদারকি করেন। হেটে হেটে প্লেটে খাবারও তুলে দেন।
এবার বিদায়ের সময় উপস্থিত। আগের মতো আবারো আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বেরিয়ে পড়ি। বেশ কিছু দূর এসে অজান্তেই মুখ ঘুরে বাংলোর দিকে ফিরে তাকাই আরেকবার। কুয়াশার চাদর ঢেকে দিয়েছে বাংলোটিকে। আবছা দেখায়। লাইটের আলোও ম্রিয়মাণ। আমারা যত আগাই বাংলোটি পেছনে সরে যেতে থাকে। একসময় বাংলোটি চোখের আড়াল হয়। আঁধারও গাঢ় তাই আর দেখতে পাই না। গাড়ির কাছাকাছি চলে আসি। বাংলোটি আস্তে আস্তে চোখ থেকে মুছে যায় কিন্তু হৃদয়ে জেগে রয় আজ সন্ধ্যার খণ্ড খণ্ড আলোকিত চিত্র,আলোকিত মানুষগুলোর মুখ। যা মুছে যাবে না কোনদিন। বহু বহু দিন-আজীবন মনের বাক্সে জমা হয়ে থাকবে।
অনেক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ ফাহিম আহমদ চৌধুরী! আরো ধন্যবাদ আমাদেরকে আপ্যায়নের নেপথ্যে যারা চরম শিষ্টাচারে ভরিয়ে দিয়েছেন অনুষ্ঠান শেষের অবধারিত পর্ব – খাবার আয়োজন।