কাছে দেখা দেখা : খ্রিস্টান যুবকের ইসলাম গ্রহণ জীবনের এক বিশেষ মুহুর্ত, অসাধারণ অনুভুতি
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪৩ মিনিটতাইসির মাহমুদ :
গেলো রমজানের মাঝামাঝি কোনো এক সন্ধ্যা। ইফতার শেষে একটা বিষয়ে কথা বলতে ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম মাওলানা আবুল হোসাইন খান-এর অফিস কক্ষে ঢুকলাম। তিনি তখন চা খাচ্ছিলেন । আমাকে দেখেই কর্তব্যরত একজনকে আরো এক কাপ চা দিতে অনুরোধ করলেন। চা খেতে খেতে কথা বলছিলাম । হঠাৎ রিসেপশন থেকে একজন এসে জানালেন, শাহাদার (ইসলাম গ্রহণ) জন্য যে যুবকের পুর্বের এপোয়েন্টমেন্ট ছিলো, তিনি রিসেপশনে অপেক্ষা করছেন ।
ইমাম সাহেব জানতে চাইলেন, তাঁর সঙ্গে সাক্ষী হিসেবে কি কেউ এসেছেন? রিসেপশনিস্ট বললেন, একজন সঙ্গে আছেন । বললেন, সাক্ষী তো দু’জন লাগবে। পরক্ষণে বললেন, অসুবিধা নেই, ভেতরে পাঠিয়ে দেন। তাইসির ভাই আছেন । তিনি আজ সাক্ষীর ভুমিকা পালন করবেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন যুবক এসে রুমে ঢুকলেন । একজন কৃষ্ণাঙ্গ । অপরজন সম্ভবত আরব কোনো দেশীয় হবেন । সালাম বিনিময় করে তারা চেয়ারে বসলেন । ইমাম সাহেব কুশল বিনিময় শেষে শাহাদাহ (ইসলামে গ্রহণ) পড়ানোর জন্য আগত যুবককে স্বস্থানে দাঁড়াতে অনুরোধ করলেন । সাথে সাথে তিনিও (ইমাম) চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। এবার তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। –আপনি কেন ইসলাম গ্রহণ করছেন? কেউ কি আপনাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে? আপনার পরিবারে কে কে আছেন? বাবা-মা কোন ধর্ম অনুসরন করেন । আপনার পেশা কী- ইত্যাদি ইত্যাদি ।
প্রশ্নোত্তরপর্ব শেষ হলে তিনি ‘শাহাদাহ’ পড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করলেন। “আশহাদু, আল-লা-ইলাহা.. এভাবে থেমে থেমে একটি একটি করে শব্দ উচ্চারণ করতে থাকলেন । কৃষ্ণাঙ্গ যুবকও সাথে সাথে শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন ।এরপর আবার শাহাদাহ’র শব্দগুলো ইংরেজী ভাষায় (আই বেয়ার উইটনেস……) অনুবাদ করে উচ্চারণ করতে থাকলেন । সাথে সাথে যুবকও একটি একটি করে শব্দ উচ্চারণ করলেন ।
মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ইসলাম গ্রহণের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলো। এরপর একটি নির্ধারিত ফর্মে যুবক স্বাক্ষর করলেন। তাঁর সঙ্গে আসা যুবক ও আমি সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করলাম। সবশেষে ইমাম সাহেব স্বাক্ষর করে সার্টিফিকেটটি হাতে তুলে দিলেন।
এবার ইমাম সাহেব ওঠে এসে যুবকের সঙ্গে আলিঙ্গন করলেন। আমিও চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালাম। আলিঙ্গন করলাম। তিনিও আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
তিনি যখন জড়িয়ে ধরে আমার সঙ্গে আলিঙ্গন করছিলেন তখন আমার মধ্যে এক ভিন্ন অনুভুতি কাজ করছিলো । আমি ভাবছিলাম, এই মুহুর্তে পৃথিবীর একজন নিষ্পাপ মানুষকে স্পর্শ করছি। এই কিছুক্ষণ আগেও যিনি অমুসলিম ছিলেন, এখন তিনি মুসলিম । তাঁর জীবনটি সম্পুর্ণ পালটে গেছে। জীবনের নতুন একটি অধ্যায়ে তিনি পা রেখেছেন । ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে তার বিগত ৩৬ বছরের জীবনের পাপ পঙ্কিলতা মুছে গেছে । তিনি এখন সদ্যজাত শিশুর ন্যায় একজন পুতপবিত্র মানুষ । আমি একজন পবিত্র মানুষের সঙ্গে আলিঙ্গন করছি।
ইতিপুর্বে মসজিদের মিম্বরে অনেককে ইসলাম গ্রহণ করতে দেখেছি । কিন্তু এভাবে কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়নি। একজন যুবকের জীবন পাল্টানোর সাক্ষী হলাম । একটি ইতিহাস রচিত হলো আমার চোখের সম্মুখে । ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে যুবকের চেহারায় অসাধারণ পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম । তাঁর চোখে-মুখে তৃপ্তি ও প্রশান্তির আভা জ্বলজ্বল করছিলো । আমি পরম আগ্রহ নিয়ে কিছুক্ষন তাঁর সঙ্গে কথা বললাম । জানতে চাইলাম ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পেছনের গল্প।
যুবকের নাম ‘কিরন স্টুওয়ার্ট’ । জ্যামাইকান বংশোদ্ভুত বৃটিশ নাগরিক । বয়স ৩৬। এখনও বিয়ে করেননি । বসবাস করেন সাউথ লন্ডনের মিচাম ট্যামওয়ার-ওয়ার্থ লেন এলাকায়। তাঁর পুরো পরিবার খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী । ৫ ভাই ৪ বোনের পরিবার । সাউথ লন্ডনে মা, দাদী ও খালা বসবাস করেন । স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করেছেন । লেখাপড়া শেষ করে সাউথ লন্ডনের পাটনী এলাকায় একটি জিপি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করেছেন । প্রায় ২০ জন ডাক্তার আছেন । তিনি সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । তাঁর পিতা একজন ইন্টারন্যাল হাউজিং ডিজাইনার। তবে তিনি যখন খুব ছোট তখনই তাঁর মা-বাবা পৃথক হয়ে যান ।
ইসলাম ধর্ম তাঁকে কীভাবে আকৃষ্ট করলো- জানতে চাইলে কিরন বললেন, “আমার বন্ধু-বান্ধবদের অধিকাংশই মুসলিম । কেউ অন্য ধর্ম থেকে কনভার্ট হয়ে এসেছেন । কেউবা জন্মগতভাবেই মুসলিম । তাঁদের সঙ্গে আমার সার্বক্ষনিক ওঠাবসা। তাদের জীবনযাপন আমাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে । আমি তাঁদের কাছে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতাম। তারা আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন । আমাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। এভাবেই ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য আমাকে আকৃষ্ট করে । একসময় মনের মধ্যে কেমন যেন এক আকুতি অনুভব করি। আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করছিনা । এতো সুন্দর ধর্ম। যে ধর্মে মানুষে মানুষে সাদা-কালো কোনো ভেদাভেদ নেই। সকলেই মসজিদে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েন । এটা ভাবতে ভাবতে একসময় আমার মনের মধ্যে কেমন যেন এক অনুভুতি কাজ করে। এভাবেই একসময় ইসলামকে আলিঙ্গন করে নিই। মনে হয়, এটা আমার জন্য সৃষ্টি কর্তার নিকট থেকে একটি বিশেষ ডাক।
খ্রিষ্টধর্মের বিশ্বাস ভঙ্গ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে আপনি কি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা বোধ করছিলেন?- নাহ, খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী হওয়াটা আমার জন্য মুসলিম হতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি । খ্রিস্টান ধর্মের সাথে ইসলাম ধর্মের অনেক মিল আছে । ইসলাম ধর্ম সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে আমার বিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করেছে । খ্রিষ্টান ধর্মে সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে যেসকল জায়গায় আমার সন্দেহ ছিলো, সেগুলো সম্পর্কে ইসলাম স্পষ্টতা দিয়েছে ।
আপনার পিতা-মাতাকে যখন ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছার কথা বললেন, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিলো? -“তারা কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাননি। কারণ ইসলামের প্রতি তারা খুবই শ্রদ্ধাশীল। তাদের ধারণা খুব সুউচ্চ । কারণ আমাদের বন্ধু-বান্ধব সকলেই মুসলিম । তাই তাদের মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্যটুকু তারা উপলব্ধি করে আসছিলেন। আমার পরিবার আমাদের প্রত্যেকের জন্য সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জানা-বুঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহনশীল এবং মহান সৃষ্টিকর্তার উপাসনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
আপনার মুসলিম নাম কি?- “আমি এখনও মুসলিম নাম সম্পর্কে চিন্তা করিনি । বর্তমান নামেই সকলে আমাকে ডাকেন । তবে একটি সুন্দর নাম খুঁজছি । আমি মনে করি, যে নামটি আমি বেছে নিবো সেই নামের অর্থ যেন আমার মধ্যে প্রতিফলিত করতে পারি।
আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?- “এই মুহুর্তে কেবল ইসলাম ধর্ম শেখা এবং অনুশীলন করাই আমার মুল লক্ষ্য’।
খ্রিস্টধর্মের সাথে ইসলামের তুলনা করলে আপনি কী পার্থক্য দেখতে পান ? -“ইসলাম ধর্ম মনের মধ্যে এক শান্তির অনুভূতি জাগ্রত করে । সৃষ্টিকর্তাকে জানা, তার আদেশ নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে আমি উপলব্ধি করি তিনি আমার সঙ্গে আছেন, তিনি প্রতিনিয়ত আমার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন । আমি ইসলাম ধর্মে যা অনুভব করি, খ্রিস্টধর্মে তা কখনো অনুভব করতে পারিনি”।
ইসলামকে আলিঙ্গন করার আপনার অনুভূতি কেমন?- ‘এক কথায় পরম শান্তি এবং সুখ’।
কথা বলতে বলতে এশার আজান হয়ে যায়, তাই আলাপচারিতার সমাপ্তি টানতে হয় । হ্যাণ্ডশেক করে কিরন ও তাঁর বন্ধু আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন । তবে বিদায়ের আগে তাঁর মোবাইল নাম্বারটি দিয়ে গেলেন । বললেন, আপনার সাথে কথা বলতে পারাটা আমার জন্য সৌভাগ্যের। আমার নতুন জীবনের যাত্রা সম্পর্কে আরও বেশি বলতে পারলে আমি খুশি হব । মুসলিম কমিউনিটির সাথে নিজেকে একীভূত করতে চাই। আমি আরও পড়তে চাই, জানতে
চাই। ইসলামের সৌন্দর্যাটুকু পুরোপুরি উপভোগ করতে চাই।
পরে খবর নিয়ে জানলাম বছরজুড়ে এভাবেই শতাধিক নন-মুসলিম ইস্ট লন্ডন মসজিদে এসে ইসলাম গ্রহণ করে থাকেন । মসজিদ নিউ-মুসলিমদের পরবর্তী জীবন-যাপনে বিভিন্নভাবে গাইড করে থাকে।
তাইসির মাহমুদ
ডেগেনহ্যাম
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
রোববার ২৩ এপ্রিল