স্বপ্ন ও ভাবনা সাফল্যের চাবিকাটি -সহকারী অধ্যাপক শেখ আব্দুর রশিদ
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মার্চ ২০২৩, ৩:৫৪ মিনিটজন্ম তাঁর ১৯ শতকের শেষভাগে, ব্রিটিশ ভারতের মধ্য প্রদেশে এক দরিদ্র পরিবারে। অস্পৃশ্য হরিজন হওয়ায় স্কুলে তাঁকে বসতে হতো ক্লাসের বাহিরে বারান্দায়। এমনকি তেষ্টা পেলে স্কুলের উচ্চবর্ণের দপ্তরী ছোঁয়া বাচিয়ে ওপর থেকে পানি ঢেলে না দেয়া পর্যন্ত পানি পানের অনুমতিটুকুও ছিলো না তাঁর। দপ্তরী যেদিন স্কুলে থাকতো না সেদিন তাকে তৃষ্ণার্ত হয়েই কাটাতে হতো। এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে ১৯ মাইল দূরের পরীক্ষাকেন্দ্রে যাচ্ছিলেন কিন্তু মাঝপথে গাড়োয়ান নামিয়ে দিয়েছিলো অস্পৃস্য হওয়ার অপরাধে। এই মানুষটি-ই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন তুখোড় অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক। হয়েছিলেন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী। দলিতরা যাকে ভালোবেসে ‘বাবা সাহেব’ বলে ডাকেন এবং ১৯৯০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ উপাধি ‘ভারতরত্ন’ -তে ভূষিত করা হয় তাকে। আর তিনি হলেন ভারতের সংবিধান প্রনেতা ড. বি আর আম্বেদকর।
ড. আম্বেদকর রাগে ক্ষোভে গাড়োয়ালকে গালিগালাজ করতে পারতেন, পড়া বাদ দিয়ে দিতে পারতেন, শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবি করতে পারতেন। তার কিছুই করলেন না। তার প্রতি অবজ্ঞা অবহেলার শোধ তিনি নিলেন নিজেকে উচ্চমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করে।
স্বপ্ন বা ভাবনা কিভাবে বাস্তব হয় তার উদাহরণ দক্ষিন আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নেলসন মান্ডেলা। শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের কারাগারে বন্দী ছিলেন ২৯ বছর। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তাঁর পরিচয় ছিলো সন্ত্রাসী। কারাগারের অতি নির্জন সেলে রাখা হয়েছিল, যেখানে সূর্যের আলো পৌছাত না। কারাগার থেকে মুক্তির পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কারাগারে কি করতেন আপনি। তিনি বললেন, সব সময় স্বপ্ন দেখেছি মুক্ত দক্ষিন আফ্রিকার। যেখানে কৃষ্ণাঙ্গরা শাসন করছে। আর আমি তার নেতৃত্ব দিচ্ছি। মান্ডেলা আলোচনার টেবিলে শ্বেতাঙ্গদের পরাজিত করে কৃষ্ণাঙ্গ শাসন কায়েম করেন। আর তিনি হন দক্ষিন আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। বর্ণবাদের অবসান, মান্ডেলা মুক্ত দক্ষিন আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হবেন এটা কল্পনা করাও ছিলো দুঃসাধ্য। ঘটনাগুলো অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য এবং বাস্তব।
২৬ জানুয়ারী ২০১৭ নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকার প্রচ্ছদ নিবন্ধ হচ্ছে – আ মিনিং টু লাইফঃ হাউ আ সেন্স অব পারপাজ ক্যান কিপ ইউ হেলদি। ১৪ বছরের গবেষণার প্রেক্ষিতে বলা হয়, একজন মানুষ জীবনকে নিয়ে কি করতে চায়, এই উদ্দেশ্যটা যদি তার কাছে পরিস্কার থাকে, তাহলে সে বেশিদিন বাঁচে এবং ঘুমায় ভালো। জীবনের লক্ষ্য মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং ডিপ্রেশনের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
লক্ষ্য যদি থাকে, তাহলে মানুষ ডিমেনশিয়া ও আসক্তি থেকে মুক্ত থাকে, এমনকি তার ডায়াবেটিস হলে গ্লুকোজের লেভেলটাও ঠিক থাকে এবং লক্ষ্যহীন মানুষের তুলনায় যারা লক্ষ্য স্থির করতে পেরেছে তাদের আয়ু ১২ শতাংশ বেড়ে গেছে।
জীবনের একটি বড় স্বপ্ন বা লক্ষ্য থাকলেও তা অর্জনে ছোট ছোট কাজগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানের কাজগুলোকে দক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়ে সবচেয়ে ভালভাবে করেই তবে বড় স্বপ্নে পৌঁছাতে হয়।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সমুদ্রপারের তাঁতিকন্যা ফাতিমা-ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিলো সে রাজরানী হবে, তার ঐশ্বর্যকে সে ব্যয় করবে দুস্থ- বঞ্চিতদের কল্যাণে। এক গরিব তাঁতিকন্যার তুলনায় স্বপ্নটা অনেক বড় বৈকি। কিন্তু সারাদিন কাপড় বুনতে বুনতে সে এ স্বপ্নই দেখে। অবশেষে তার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে বাবা তাকে নিয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা করলেন। গন্তব্য মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া। পথিমধ্যে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবি হলো। ফাতিমা হারিয়ে গেল তার বাবার কাছ থেকে। সমুদ্রতীরে এক বৃদ্ধ জেলে তাকে পেয়ে নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। সেখানে ফাতিমা শিখলো দড়ি পাকিয়ে জাল বুনতে।
কিছুদিন পর আবার তার জীবনে নেমে এলো দুর্বিপাক। জলদস্যুরা তাকে অপহরণ করে বিক্রি করলো বসরার এক সওদাগরের কাছে ক্রীতদাসী হিসেবে। সওদাগরের ছিলো জাভা থেকে কাঠ আমদানি করে নৌকা বানানোর ব্যবসা। সেখানে সে আয়ত্ত করলো কাঠ চেরাই আর মাস্তুল বানানোর প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে কয়েকবার জাহাজডুবিতে সওদাগরের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলো, লোকজন তাঁকে ছেড়ে চলে গেল। তখন বুদ্ধিমতী ও বিশ্বস্ত ফাতিমা মনিবের পাশে দাঁড়ালো। মনিব তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ব্যবসায়ে অংশীদার করলেন। ফাতিমা কাঠ আনতে সমুদ্র পথে জাভার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কিন্তু আবার ঝড়, আবারও নিরুদ্দেশে ভেসে যাওয়া। এবার ফাতিমা গিয়ে পড়লো চীন দেশে। জ্ঞান ফিরে সে দেখলো, মহাসমারোহে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাজপ্রাসাদে।
ঘটনা ছিলো এরকম- চীনদেশের রাজপুত্রের বিয়ে সম্পর্কে রাজ- জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, হবু কনে পূর্ণিমার রাতে সমুদ্র থেকে আসবে, যার ভাষা, চেহারা হবে আলাদা এবং সে তাঁবু বানাতে পারবে। পারিপার্শ্বিক সব মিলে গেল। এবার তাঁবু বানাতে হবে। ফাতিমা নেমে পড়লো তাঁবু বানাতে। কাপড় বোনার অভিজ্ঞতা থেকে কাপড় বানালো । জাল বানানোর অভিজ্ঞতা থেকে দড়ি বানালো। আর মাস্তুল বানানোর অভিজ্ঞতা থেকে বানালো তাঁবুর খুঁটি। তাঁবু তৈরি হলো। রাজা নিশ্চিত হলেন এই সে মেয়ে । পূরণ হলো ফাতিমার আজন্ম লালিত স্বপ্ন।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লতিফা শফি ডিগ্রী কলেজ,সিলেট
চেয়ারম্যানঃ সিফডিয়া, সিলেট সেন্টার ফর ইনফরমেশন এন্ড ম্যাস মিডিয়া।
মোমেন্টিয়ার, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন