বড়দিন’ নিয়ে শ্বেতাঙ্গ প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপচারিতা
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ৯:০৫ মিনিটতাইসির মাহমুদ :
ডিসেম্বর । ঈসায়ী (ইংরেজি) বছরের শেষ মাস। বৃটেনে এই মাসে সবকিছুতেই কেমন যেন এক স্থবিরতা অনুভব করা যায় । বিশেষ করে মাসের শেষের দিনগুলোতে। শুক্রবার বিকেল থেকে সবচেয়ে বেশি স্থবিরতা লক্ষ্য করা যায়। কারণ ওইদিনটি ছিলো অফিসপাড়ায় এই বছরের শেষ কর্মদিবস। কাজ শেষে করে বিদায় নিয়েছেন সকলে । আর ফিরবেন নববর্ষের প্রথম সপ্তাহে। তবে মধ্য-জানিয়ারি পর্যন্তই এই স্থবিরতা থেকেই যায় । কর্মদিবসগুলো কেমন যেন অলস অলস মনে হয়। অফিসপাড়া, দোকানপাঠ, ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হতে জানুয়ারি শেষ হয়ে যায়। মুল কারণ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ‘ক্রিসমাস’। বাংলায় আমরা বলি ‘বড়দিন’।
রোববার ২৫ ডিসেম্বর ‘বড়দিন’ । লন্ডনের রাস্তাঘাটে কেমন যেন সুনসান নীরবতা। রাস্তায় গাড়ি চলাচল ও হৈ হল্লুড় কম। দোকানপাঠে মানুষের আনাগোনা কম। হলিডে কাটাতে অগ্রীম ছুটি নিয়ে অনেকেই মধ্য ডিসেম্বরে বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন। শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টানদের অধিকাংশই বড়দিনের কেনাকাটা করে এখন ঘরে ঘরে পার্টিতে ব্যস্ত । ঘরগুলোর সাজানো হয়ে ভিন্ন সাজে। রাস্তায় দেখা হলে ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’ বলে পরস্পর কুশল বিনিময় করছে । আমাদের বৃটিশ-বাংলাদেশীর ঘরেও চলছে ছুটির আমেজ, পারিবারিক গেট-টুগেদার।
২৫ ডিসেম্বর ঈসা নবীর (আঃ) জন্মদিন (যদিও মতানৈক্য আছে) । খিস্টানরা (কুরআনের ভাষায় নাসারা) ঈসা নবীর অনুসারি । কিন্তু নবীর জন্মদিন তারা শুধু একটি উৎসব হিসেবেই পালন করে । মুসলমানদের ঈদে যেমন আনন্দ উদযাপনের পাশাপাশি ধর্মের নির্দিষ্ট কিছু বিধান পালন করতে হয়, খ্রিষ্টানদের বড়দিনে তেমন কোনো প্রচলন মোটেই চোখে পড়েনা। শুধু একটি উৎসব হিসেবেই তারা দিনটি উদযাপন করে । খাওয়া দাওয়া, গিফট দেওয়া, শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়, রেস্টুরেন্টে যাওয়া, মদবারে গিয়ে একটু দামী মদ্যপান করা-এই হচ্ছে ক্রিসমাস বা বড়দিন।
আমার ইংরেজ প্রতিবেশী গ্যারি হাম্প্রিজ । খ্রিষ্টানধর্মে বিশ্বাসী। আমাদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক। ঈদে আমরা পিঠাপায়েশ দিই। বড়দিনে তারা চকলেট, কেক পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
দিন কয়েক আগে প্রসঙ্গক্রমে তাঁর সঙ্গে বড়দিন নিয়ে কথা হচ্ছিলো । জানতে চাইলাম, ক্রিসমাস তাদের কাছে এতো গুরুত্বপুর্ণ কেন? বললেন, জিসাসের (ঈসা নবী) জন্মদিন। বললাম, জিসাসকে কি প্রফেট হিসেবে মানেন? বললেন, ‘তিনি তো সান অব গড, আবার তিনি নিজেই গড । (তিনি আল্লাহর পুত্র, তিনি নিজেই আল্লাহ)। এরপর আরো কিছু কথা হলো। আমি অবশ্য তেমন কিছু বললাম না। প্রতিবেশী মানুষ । ধর্ম নিয়ে হঠাৎ বেশি কথা বলা সমিচীন মনে করিনি । শুধু বললাম, “আমরা বিশ্বাস করি তিনি আল্লাহর রাসুল । যিনি সৃষ্টিকর্তা তাঁর আবার সন্তান থাকবে কীভাবে? কুরআন বলেছে, “সৃষ্টিকর্তা কাউকে জন্ম দেননি, তিনি কারো কাছ থেকে জন্মগ্রহণও করেননি । তিনি এক ও অদ্বিতীয় । তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।” তিনি আমার কথায় কোনো দিমত করলেন না। শুধু বললেন, আমি ধর্ম নিয়ে তেমন ভাবিনা। গির্জায়ও খুব একটা যাই না।
করোনা মহামারির সময় বৃটেনে যখন প্রতিদিন হাজার দুইয়েকের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছিলেন তখন একদিন কথা হলো। জানতে চাইলাম, করোনা সম্পর্কে তার ভাবনা কি? গডের কাছে কি প্রার্থনা করেন? বললেন, তিনি এ নিয়ে তেমন কোনো চিন্তাভাবনা করেন না। জিসাসের কাছে প্রার্থনা করেন। আবার মাঝে মাঝে কেনো সমস্যায় পড়লে সোজা চলে যান ডেগেনহ্যাম সেমিট্রিতে। সেখানে তার বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সমস্যার কথা জানিয়ে আসেন । এতে কাজও হয়।
এরপর এই সেই আরো কিছু কথা হলো। প্রাথমিক আলাপে আমি শুধু বলার চেষ্টা করলাম, “ঈসাকে আমরা একজন প্রফেট বলেই বিশ্বাস করি। তিনি আল্লাহর পুত্র নন। অবশ্য এ নিয়ে তাঁর তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই। জিসাস ‘সান অব গড’ হলে ঠিক আছে , আবার রাসুল হলেও হতে পারেন । এতেও যেন কোনো অসুবিধা নেই। অনেকটা সুবিধাবাদী ধার্মিক।
এভাবেই এদেশের খ্রিষ্টানরা নামেই খ্রিষ্টান। ধর্মের প্রাকটিস একেবারেই কম। ধর্ম নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই । ধর্ম মানে হচ্ছে একটি কালচার। একটি উৎসব। ধর্ম মানে ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’।
সে যাক, ক্রিসমাসকে কেন ‘বড়দিন’ বলা হয়-এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজছিলাম। কিছু ঘাটাঘাটি করে যা পেলাম, তা হলো: ২৫শে ডিসেম্বর হতে যুক্তরাজ্যে দিন ক্রমশ বড় এবং রাত ছোট হতে শুরু করে বলে একে ‘বড়দিন’ বলে।
তবে আরো একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি, ঈসা নবীর জন্মদিন (২৫ ডিসেম্বর) থেকে যদি ঈসায়ী সাল গণনার সুচনা হয়ে থাকে, তাহলে ১লা জানুয়ারি কেন বছরের প্রথমদিন? প্রথমদিন তো ২৫ ডিসেম্বরই হওয়ার কথা?
ডেগেনহ্যাম
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
রোববার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২২