বইমেলায় লেখক ও ভক্তদের খণ্ডচিত্র
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:০৩ মিনিটআনোয়ার হোসেন মিছবাহ্
(০১)
পবন সাহিত্য পরিষদ সিলেট ও সৃজনশীল পাবলিশার্স গিল্ড ঢাকা’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ৫ দিনব্যাপী বইমেলা ও পাঠকের সাথে লেখকের মুখোমুখি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবেন এ সময়কার জনপ্রিয় ৩ জন লেখক- হুমায়ূন আহমেদ,ইমদাদুল হক মিলন ও জাফর ইকবাল।তাঁরা পাঠক কর্তৃক প্রশ্নে সরাসরি উত্তর দেবেন।এ অনুষ্ঠানের প্রথম দিনেই উপস্থিত হচ্ছেন-জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ।এ সংবাদ শুনেই যেনো ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সিলেট’ এ উপচে পড়া দর্শক,ভক্তের ঢল নেমেছে।অস্থিরভাবে পায়চারি করছে-অগুন্তি ভক্তের দল।এমনি সুন্দর বিকেলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আমিও। আমার পাশ হতে এক তরুণী মুখের ম্যাকআপ ঠিক করতে করতে বান্ধবীকে বলছেন-“ইস্ সোমা!আমার প্ল্যানটাই মাটি হয়ে যাবে,যদি না আসেন।অনেক যত্ন করে নিজ হাতে তোড়াটি বানিয়েছি।ভাবছিলাম;এটি নিজে ই হাতে তুলে দিয়ে একটি বারের জন্যও কথা বলব;আমার প্রিয় লেখকের সাথে।”
তাদের কথা না ফুরাতেই ভিড় ঠেলে উপস্থিত হলেন,জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ।অমনিতেই লাফ দিয়ে উঠলো,তরুন-তরুনীর দল।হুমড়ি খেয়ে পড়লো সবাই।কেউ চায় অটোগ্রাফ,কেউ একটিবার কথা বলতে অথবা ছুঁয়ে দেখতে চায় প্রিয় লেখকের শরীর।কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছেন এদের সামাল দিতে।ধাক্কাধাক্কি করেও কোন কিনারা পাচ্ছেন না।গমগম করা হলের মধ্যে জনাব,সালেহ চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখলেন,আয়োজকদের একজন- জনাব,মনির উদ্দিন চৌধুরী।এর পর বক্তব্য রাখলেন,লেখক।তাঁর বক্তব্যে শৈশবের কথা পাঠকদের শুনালেন।শুধালেন,লেখালেখির অনেক কথা।তারপর বক্তব্য।এ সব করেই লেখক ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।তাঁকে গার্ড অফ অনার এর মতো কর্তৃপক্ষ নিয়ে গেলেন পাঠাগারের ভেতর। সেখানেও অসম্ভব রকমের ভিড়।এ ভিড় ঠেলেও সন্ধ্যা ৬ টার দিকে তাঁকে বেরিয়ে যেতে হলো,তাঁর জন্য ব্যবস্থাধীন স্হানে।
(০২)
আজ অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন ১১ জুন সকাল ৯ টা থেকে ভক্তদের মিলনস্থলে পরিণত হচ্ছে সংসদ চত্বর।এ কোন নাচ-গানের মেলা নয়,এ মেলা বইয়ের মেলা।পাঠকের মুখোমুখি লেখকের মেলা।তবুও উপচে পড়া মানুষ।আজও আসবেন হুমায়ূন আহমেদ।এ খবরটি গতকালই জেনে নিয়েছিলেন ভক্তরা।সকাল ১১ টায় আসবেন হুমায়ুন।কিন্তু আসছেন না কেনো?এ যেনো শত ভক্তের মিলিত আর্তি। সবাই ক্যামন অস্থির সময় কাটাচ্ছেন।১১ টায় আসলেন না লেখক।আসলেন-দুপুর ১২ টায়।তিনি মঞ্চে ওঠার সাথে সাথেই অটোগ্রাফ পাগলদের গাদাগাদি শুরু হলো।সামাল দিতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ।শান্তি শৃঙ্খলার পক্ষে আমার একটু সাড়ম্বরতা দেখে ভলেন্টিয়ার এর ব্যাজ পরিয়ে দিলো বন্ধু ফায়সাল তালুকদার।আমারও যেনো এ রকমটা চাওয়া ছিলো!যাক অন্ততঃধারে কাছে যাওয়া যাবে প্রিয় লেখকের।হলো ও তাই।লেখক মঞ্চে আমাকে এতোই সক্রিয় থাকতে হলো,যেনো প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব পালন করছি!
এ অবস্থার মধ্যেও ভক্তদের নিরাশ করলেন না লেখক হুমায়ূন আহমেদ।অটোগ্রাফ দিতে সম্মতি দিলেন।আর যায় কোথায়?বই,ডায়রী,খাতা,প্যাড,লে
লেখক এ মিনতি ভরা কন্ঠ শুনে আমাকে বললেন-“ও কে আসতে দেন।”মেয়েটিও আসলো। তৃপ্তির সাথে কথা বললো।ছবি ওঠালো।পরে চলে গেলো।এ সময় ২ টার ঘরে ঘড়ির কাঁটা।ক্যাসেট প্লেয়ারে হাসন রাজা র’গান বাজছে তো বাজছে ই…এপিঠ-ওপিঠ,বার বার।হুমায়ূন আহমেদ আমাকে ডেকে ফিসফিস করে বললেন-“ক্যাসেট কী আর নেই?এক গান বার বার শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। দয়া করে ক্যাসেট টা পাল্টে দেন।”
আমি খোঁজাখুঁজি করে অন্য কোন ক্যাসেট না পেয়ে ক্যাসেট প্লেয়ার টি বন্ধ করে দিলাম।
অটোগ্রাফ দিতে দিতে ক্লান্ত লেখক লাঞ্চের জন্য মঞ্চ থেকে নেমে আসলেন।ভক্তরা আস্তে আস্তে কমতে থাকলো।আমিও সুযোগ টি লাঞ্চের জন্য কাজে লাগালাম।টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে আষাঢ়ের আগমনী বৃষ্টি।লেখক গাড়িতে উঠছেন।আমি উঠছি রিকশায়।
(০৩)
বিকেল ৫ টায় হুমায়ূন আহমেদ মঞ্চে আসবেন।এ পর্ব মুখোমুখি জবাব দেবার পাঠকের প্রশ্নের। আমি ঠিক সাড়ে ৪ টায় এসে উপস্থিত হলাম।এ সময় ও পূর্বাপর অবস্থার সাথে পরিচিত হতে হলো।একজন মহিলা আমার নাম জানেন না।পকেটে ব্যাজ দেখে আমাকে ডাক দিলেন-“এই যে,চেকশার্ট ভাই!”এ রকম দু বার ডাকার পর আমি পেছনে তাকালাম।উনি আমাকে ই ডাকছেন।আমি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বললেন-” মাইন্ড করবেন না প্লিজ, আপনার নাম তো জানি না,তাই গায়ের চেকশার্ট দেখে শার্টের নামে ই ডাকলাম।”আমার বেশ মজা লাগলো অদ্ভুত নামকরণে।কিছু মনে করলাম না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন-“সত্যি কি এখানে আবার আসবেন হুমায়ূন আহমেদ?”আমি হাঁ সূচক জবাব দিলাম।তিনি এতে যেনো সন্তুষ্ট হলেন না মনে হলো।বললেন-“দিব্যি করে বলুন,উনি আসবেন তো?”আসবেন।এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই।কিন্তু তিনি কিছুক্ষনে আসলেন না।ফোন এলো-শাহাপরান মাজার থেকে এই মাত্র রওনা হয়েছেন লেখক।এখানে পৌঁছাতে সাড়ে ৬টা হবে।এলেন- ৬.৪০ মিনিটে।তুমুল করতালির মধ্যে মঞ্চে উঠেই অটোগ্রাফ দেবেন না,আমাদের জানিয়ে দিলেন।আমরা কয়েকজন কর্মী সারাদিন পাঠকদের দেওয়া প্রশ্ন বাছাই করেছি। তা লেখকের হাতে দিলাম।তিনি প্রশ্নের এ স্তুপ দেখে রসিকতা করে বললেন-“এতো প্রশ্ন দেখে ভয় লাগছে,মনে হচ্ছে,আমি একজন ছাত্র।সমস্ত উপস্থিতিকে আমার বিজ্ঞ পরীক্ষক বলে মনে হচ্ছে।আমি যেনো তাদের সামনে ইন্টারভিউ দিতে বসেছি।”
এ কথা শুনেই মনে হলো সকলেই খুব ভালো লাগায় করতালি দিয়ে সরল স্বীকারোক্তি কে
অভিনন্দিত করলেন।এবার উত্তর দিতে শুরু করলেন।যা অনেকাংশেই লেখক এর অনন্য সৃষ্টি- হিমু ও মিসির আলি সংক্রান্ত।লেখক হিমু সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উত্তরে বললেন-“হিমু হওয়া ভালো,কিন্তু এ নিয়ে বাড়াবাড়ি ভালো নয়। হিমু অবশ্যই ভদ্র-নম্র হবে।”
প্রসঙ্গক্রমে একটি মেয়ে হিমুর পক্ষে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর রানওয়েতে বসে পড়ার ঘটনা বর্ণনা দিলেন।সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাড়ি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে লেখক হুমায়ূন আহমেদ বললেন-“এ দ্বীপটিতে আমি একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম।আমার অসম্ভব রকম ভালো লাগলে এখানে বাড়ি করার পরিকল্পনার কথা প্রকাশকদের জানাতেই তাঁরা এ বাড়ির জায়গা কিনে দিয়েছেন।এ আমার নিজস্ব বাড়ি নয়।এ টি কে আমি সৃজনশীল মানুষের জন্য রেখে দিয়েছি।”এ রকম করে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলেন হুমায়ূন।প্রশ্নের পাহাড় বেয়ে এক সময় শেষ মাথায় পৌঁছালেন।এবারে অটোগ্রাফ সংগ্রাহকদের ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো।তারা সবাই চাচ্ছেন মঞ্চে উঠতে। এ দলে কয়েকজন হলুদ পাঞ্জাবি,রুক্ষ চুল,কয়েকজন ‘হিমু’কে দেখা গেলো।একজন আমাকে বেশ চেঁচিয়ে বলছেন,- “এই যে,আমাকে একটিবার স্যারের সাথে দেখা করতে দিন। নতুবা জোর করে ওঠে যাবো।”
আমি তার নাম জিজ্ঞেস করলাম।তিনি বললেন,-“নাম আবার কী?আমি হিমু।এটাই আমার নাম।তার এ ধরনের কথায় সহকর্মীরা মঞ্চে উঠতে দিলেন।হিমু একদৌঁড়ে মঞ্চে ওঠে ই হুমায়ূন আহমেদ কে পেছন থেকে বাহুবিষ্ট করতে চাইলেন।আমি লেখকের ঠিক পেছনে থেকে তাঁর হাত ঝাঁপটে ধরে জোর করে নামিয়ে দিলাম।প্রকাশকদের তুমুল বাঁধা উপেক্ষা করেও ভক্তদের নিরাশ করলেন না হুমায়ূন আহমেদ।তিনি অটোগ্রাফ দিয়ে চললেন।এদিকে বিশ্বস্থ একজনের পকেট এ আমার বুক পকেটের ব্যাজ টি পরিয়ে দিয়ে ১১৫ তম সাহিত্য আসরে চলে আসলাম।
(০৪)
সাহিত্য আসর বসেছে সংসদে।উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।অনেক নতুন লেখক এসেছেন আজ।১১৫ তম সাহিত্য আসর টি কবি ফররুখ আহমদ এঁর ৭৮ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে নিবেদন করা হলেও স্থগিত করা হলো।কারণ একটাই আজকের আসরের প্রধান অতিথি হুমায়ূন আহমেদ।সভাপতিত্ব করছেন-সাবেক পৌরসভা চেয়ারম্যান আ.ফ.ম কামাল এ্যাডভোকেট।এক এক করে স্বরচিত লেখা পাঠ করছেন-সর্ব জনাব,হাজী মৌলুল হোসেন,সিরাজুল হক,আব্দুল জলিল চৌধুরী,নাজমুল আনসারী,শাহাদাৎ হোসেন,ফয়সাল তালুকদার,নাজনীন আক্তার কণা,আশরাফ হাসান,মতিউল ইসলাম মতিন,রকিব আল হাফিজ,আব্দুল সাদেক লিপন,ইমরান আহমদ চৌধুরী,ইমরানূল বারী,ইসমাইল হোসেন সৌরভ,আব্দুল কাইয়ূম,শায়েখ তাজুল ইসলাম আউয়াল মহলী,সুমন বিপ্লব,এখলাছুর রহমান,আব্দুল ফাত্তাহ,সাহেদ হোসাইন,সজল চন্দ্র ঘোষ,মোহাম্মদ নওয়াব আলী,কামাল আহমদ,আল মামুন,শামসুর রহমান সুবেদ,তাজুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্,প্রমুখ।
হুমায়ূন আহমেদকে নিবেদন করে কবিতা লিখেছেন বন্ধু আবিদ ফয়সাল।কিন্তু তাকে দমিত করে রাখা হয় এই বলে যে-লেখক তো এখনও উপস্থিত হন নি,আসার পর পর ই কবিতাটি যেনো পড়া হয়।
সকলেরই নজর সদর দরজার দিকে।এখনও আসছেন না তিনি।অটোগ্রাফ দিতে দিতে ক্লান্ত লেখক আসরে ঢুকলেন-রাত প্রায় সাড়ে ৮ টায়।সাথে দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক জনাব,সালেহ্ চৌধুরী।শুরু হলো করতালি।হুমায়ূন আহমেদ সংসদে প্রবেশ করার পরপরই স্বাগত বক্তব্য রাখলেন-কবি,রাগিব হোসেন চৌধুরী।সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী ও প্রাবন্ধিক আজিজুল হক মানিক।ব্যতিক্রমী ও তথ্যপূর্ণ বক্তব্যে জনাব,আজিজুল হক মানিক আসরে উপস্থিত সকলকে যেনো ভালোলাগায় বসিয়ে রাখলেন।এর পরপরই সিলেট বিষয়ক ছড়া পড়ে শুনালেন-জনাব,শারিক শামসুল কিবরীয়া ও লেখক নিবেদিত কবিতা পাঠ করে শোনালেন- বন্ধু আবিদ ফায়সাল।এবার লেখকের বক্তব্যের পালা।তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই বললেন-” আমি একটু টায়ার্ড ফিল করছি।মনে কিছু যদি না নেন,তাহলে বসে বসেই বলি।এ ব্যাপারে সমস্বর সম্মতি দিলে তিনি প্রথমেই তাঁর পরিহিত সাদা পাঞ্জাবির ছেঁড়া বোতাম দেখিয়ে বললেন; তাড়াহুড়াে করে পরতে গিয়ে এগুলো ছিঁড়ে ফেলেছি।দয়া করে এটাকে লেখকের স্টাইল মনে করবেন না।”এবার আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন-” এখানে সবাই লেখক,এদের সামনে কথা বলতে হলে মেপে মেপে ই বলতে হবে।”বলতে বলতেই লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে দু মিনিট বন্ধ থাকলো চলতি বক্তব্য।পরে জেনারেটর চালু হলে শুরু হলো অসামান্য কথা।হুমায়ূন আহমেদ বলেন-“একজন লেখকের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে-পাঠকের কাছে পৌঁছানো।যদিও পাঠককে সামনে রেখে নয়,মনের আনন্দেই লেখক সৃষ্টি করেন তার সাহিত্যকর্ম।তবুও তিনি তার আনন্দ অন্যকে শেয়ার করেন।এই শেয়ার করার তাড়না থেকেই পাঠক এবং লেখকের মধ্যে সৃষ্টি হয় সেতুবন্ধন।সৌন্দর্য বন্দী করে রাখার বিষয় নয়,বারবার আবিষ্কার করতে হবে।এই সৌন্দর্য্য আবিষ্কার ও সৌন্দর্য্যকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টাই আমার লেখক জীবনের উদ্দেশ্য।’নন্দিত নরকে’এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ আমার ২৫,২৬ বছর জীবনের বিশুদ্ধ কাঁচা আবেগের বহিঃপ্রকাশ।এখন আমি এ থেকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি।সমালোচকেরা এখন বলছেন- হুমায়ুন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ই শুধু টিকবে।অথচ,এই ‘নন্দিত নরক’এর পাণ্ডুলিপি নিয়ে কতো প্রকাশকের দ্বারে ঘুরেছি কেউ ই পাত্তা দেয়নি।আমি ব্যক্তি জীবনে একজন লাজুক টাইপের,আমার হয়ে প্রাবন্ধিক আহমদ ছফা প্রায় ৫০০ টি প্রকাশক সংস্থার কাছে আমার পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেছেন।এবং তাঁর ই প্রচেষ্টায় একটি প্রকাশনীসংস্থা এটি ছাপতে রাজি হলো।সংখ্যায় এতো কম যে,আমার খুব লজ্জা পেলো।আমার হয়ে কে একজন’নন্দিত নরক’এর একটি কপি পাঠিয়ে দিলেন,ভারতের জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এঁর কাছে। তিনি কী মনে করে যেনো এ বইয়ের একটি সমালোচনা লিখলেন।আর অমনিতেই আমার বইয়ের কাটতি শুরু হলো।একসময় প্রকাশকদের দ্বারে-দ্বারে ঘুরেছি,পান্ডুলিপিটাও পড়ে দেখার সুযোগ হয়নি তাদের।আজ তারা বস্তা-বস্তা টাকা নিয়ে আমার পেছনে ঘোরেন।টিভিতে যখন ধারাবাহিক নাটক’এইসব দিনরাত্রি’ শুরু হলো, তখন টিভি কর্তারাই বিরূপ মন্তব্য শুরু করলেন। কিন্তু যখন শেষ হলো,তখন আমাকে তারা ই অনুরোধ করলেন;হুমায়ুন সাহেব এ রকম আরেকটি নাটক লিখেন।আমি লিখলাম না।আমি লিখলাম;হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’।তারও সমালোচনা করলেন কর্তারা।তারা বললেন- এদেশে হাসির নাটকের দর্শক আছে কী?কিন্তু এ নাটক প্রচারের পর জনপ্রিয়তা পেলে এ ধরনের আরেকটি নাটক লিখতে বললেন।আমিও লিখলাম না।আমি’অয়োময়’লিখলাম।প্রচারের পর ‘অয়োময়’ ও দর্শকপ্রিয়তা পেলো।আমি লিখলাম;’কোথাও কেউ নেই’। নাটক প্রচারের পর বাকের ভাই’র ফাঁসি না হওয়ার দাবিতে রাস্তাঘাট, বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজ,সর্বস্থানে মিছিল হলো।আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ্য করলাম; কোথাও কোথাও বাকের ভাই’র কূলখানি পর্যন্ত হচ্ছে।এ রকম দৃশ্য আমি আমার জীবনেও দেখিনি।এবং কল্পণা করতে পারেনি।বাকের ভাই’র ফাঁসি কার্যকর দৃশ্য প্রচারের দিন পুলিশ পাহারা বসানো হলো টিভি ভবনে।আমার বাসায়ও পুলিশ প্রহরা বসানো হলো।আমি আমার পরিবার নিয়ে বাসা ছাড়লাম।আমার বাসায় দু-তিনটা বোমা ফাটানো হলো।এসব ঘটনা আমাকে আশাহত করেছে।আমার লেখালেখি নিয়ে সমালোচকদের নানা আক্রমনের শিকার হয়েছি।আমার জনপ্রিয়তাও অনেকের আক্রমণের বিষয় হয়ে উঠেছে।এক সময় শরৎচন্দ্র ও এমন আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।অথচ,আজ এটা দিবালোকের মতো সত্য যে,তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কাল জয়ীলেখক।কে কালজয়ী হবেন আর কে হবেন না,তা কারও পক্ষেই আগাম বলা সম্ভব নয়।জাঁকে কাঁঠাল পাকানো যায়,কিন্তু জোর করে কালজয়ী হওয়া যায় না।আমার ভেতরে যদি কোনো কালজয়ী লেখা থেকে থাকে,তবে তা বেরিয়ে আসবেই।আমি মধ্যবিত্তদের নিয়ে লেখি, এ নিয়েও অনেকে নানা মন্তব্য করেন।যে জিনিস জানি তা নিয়ে ই লেখবো। বৃহৎ জনগোষ্টী নিয়ে লেখলেই মহৎ সাহিত্য হয় না।কালজয়ী লেখক শেকসপীয়র রাজা-বাদশাহদের নিয়ে ই লিখেছেন।এর মধ্য দিয়েই আমি আমার কথা বলেতে চাই। যা বলি তা দিয়ে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব।যারা বলেন-হুমায়ূন আহমেদ এর লেখায় গভীরতা নেই।তাদের বলবো;যদি গভীরতা মাপার কোনো যন্ত্র থাকতো,তাহলে দেখতে পারতাম- কোন বইটি কতো গভীর।”এ রকম অনেক সরল সত্য বলে আমাদের মতো খুদে লেখকদের জুয়েল আইচের জাদু মন্ত্রের মতো মোহিত করে রাখলেন।
এখন সভাপতির বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হলো কেমুসাস এর আজকের সাহিত্য আসর।লেখক তাঁর সম্মানে আয়োজিত শ্রীমঙ্গলের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে স্ব চেয়ার ছেড়ে ওঠলেন। আমরাও তাঁর সাথে করমর্দন করে যার যার গন্তব্য স্থানে রওয়ানা হলাম।
শেষ হলো দু দিনের হুমায়ূন মেলা।