আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র ‘ঢিলেকাব্য’ এতো এতো জল,এতো গভীরতা
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:৩৯ মিনিট
মুহম্মদ আবদুল হান্নান
(এক)
কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র ‘ঢিলেকাব্য’ নামের অণু-কবিতাগ্রন্থ বনসাই প্রকাশন কর্তৃক অমর একুশে ২০০৯-এ প্রকাশিত হয়েছিলো। সে সময় তিনি আমাকে উক্ত গ্রন্থের একটা কপি দেন। তাতে তিনি আমাকে “প্রাণজ পরম অগ্রজ কবি” বলে সম্বোধন করেছিলেন।হয়তো প্রত্যাশা ছিলো তাঁর এ গ্রন্থটি সম্পর্কে কিছু লিখবো।নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।আমি অনুজপ্রতীম এই কবির কাছে আমার এ অক্ষমতার জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত।
আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ বেসরকারী একটি ব্যাংকে চাকুরী করেন।শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি কবিতা চর্চা করেন এবং ক্লান্ত শরীরে কোনো কোনো সাহিত্য আসরেও অংশগ্রহণ করেন।প্রত্যেক পৃষ্ঠায় তিনটি করে অন্তমিলে দু লাইনের একশত আটটি অণু-কবিতা নিয়ে তাঁর এ গ্রন্হ।গ্রন্হটির নাম ‘ঢিলেকাব্য’ হলেও কবিতা অত্যন্ত দৃঢ় ও গভীর উপলব্ধিতে পরিপূর্ণ।জীবনের বিপুল অভিজ্ঞতা ও সত্যাম্বেষণের পরিপক্ষ ফল ও বিষয় বৈচিত্রের অপূর্ব সমাহার। মা ও বাবাকে গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে।
(দুই)
প্রথমেই মা-বাবার মমতা দিয়ে অণু-কবিতা শুরু: “মা’র মন মায়াময় ছায়াময় ছাদ
বাবা’র প্রেমের মাঝে নেই অবসাদ।”
(পৃষ্ঠা-৫)
প্রথমেই মা- বাবার মমতা দিয়ে অণু-কবিতার শুরু:
“মা’র মন মায়াময় ছায়াময় ছাদ
বাবা’র প্রেমের মাঝে নেই অবসাদ।” (পৃষ্ঠা-৫)
মায়ের অন্তর স্নেহে পরিপূর্ণ যেন মাথার উপরে ছায়ার ছাদ।যা সন্তানকে রোদ ঝড়-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে।আর বাবা’র স্নেহে ক্লান্তি নেই।তা চিরপ্রবাহমান নির্ঝরিনী।মায়ের যে স্নেহ তা প্রবাসী সন্তানের জন্য নদী হয়ে প্রতিদিন চোখ থেকে ঝরে।কবির ভাষায়:
“মায়ানদী নিরবধি জননীর চোখে
রোজদিন করে শুধু দূরবাসী শোকে।” (পৃষ্ঠা-২৯)
দেশপ্রেম এই অণু-কবিতার অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়।প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে কবি স্বদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করেন:
“ঘুম জেগে প্রতিদিন বলি খুব ভোরে
প্রাণের স্বদেশ ভূমি ভালোবাসি তোরে।”(পৃষ্ঠা-৫) দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা প্রাণ দেয়,তাদের মৃত্যুতে রাজনৈতিক নেতাদের সান্তনা বাণী সুখ ভুলাতে পারে না।কারণ এসব বাণী কথার কথা কৃত্রিমতায় পূর্ণ-”
যুবকের বুক চিরে গলে পড়ে রক্ত
নেতাদের বানী গিলে শোক ভোলা শক্ত।”
(পৃষ্ঠা- ১৩)
সামাজিক ও জীবনাচারে অসঙ্গতি অণু-কবিতায় অনুরণিত হয়ে ওঠেছে।অর্থের বিনিময়ে যে কোনো অপরাধী জামিন পেয়ে যায়।সে কথাটি এভাবে ব্যক্ত হলো কবির ভাষায়-
“আইনের দড়ি বাঁধে অপরাধী-হাত
টাকা হলে জামিনের নেই জাতপাত।” (পৃষ্ঠা-৭) পরিণয়ের বয়স-সংগতি ও ভালোবাসার অসংগতি নিয়ে এই কবিতা।কিশোরীর ভালোবাসা প্রস্ফুটিত নয়,এলেবেলে।বাইশ ও পঁচিশে জীবন হলে জীবন সুখের হয়-
ভালোবাসা এলেবেলে কিশোরীর বুকে
বাইশে পঁচিশ খায় পরিণয় সুখে।”(পৃষ্ঠা-১১)
যে মানুষ রুপে পশু সে জবরদস্তিতে নারীর সম্মান হরণ করে,পক্ষান্তরে প্রেমিক যুবকের পিঠ জোছস্নাত হয়-
“নরপশু খুলে নেয় যুবতীর গিঁট
জোছনার আলো মাখে যুবকের পিঠ।” (পৃষ্ঠা-৯) কোনো মেয়ে যৌবনবতী হয়ে উঠলে তার সংবেদনশীল অঙ্গে পুরুষের চোখ পড়ে,তাতে সে অজানা আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে-
যুবতীর লাজে হাঁটে যুবকের চোখ
অজানায় কেঁপে ওঠে অসহায় বুক।”(পৃষ্ঠা-২৩)
গরীবের ভালোবাসার স্বরূপ চিত্রিত হয়েছে এই অণু-কবিতায়-
ভালোবাসা ঘুণপোকা কুরে কুরে খায়
খিদে পেটে মাথা ছেড়ে পালায়-পালায়।”(পৃষ্ঠা-২৩)
অর্থাৎ ভালোবাসা মানুষকে ভেতরে ভেতরে ক্ষয় করে,কিন্তু ক্ষুধার্থের ভালোবাসা থাকে না,অনটন পালিয়ে যায়।যারা গৃহহীন,ফুটপাতে রাত কাটায়,সে সব নারী ঘুমের মধ্যে গুন্ডা-বদমায়েশ দ্বারা আক্রান্ত হয়।মাত্র দু’টি লাইনের ইঙ্গিতপূর্ণ পঙ্ ক্তি দিয়ে কবি এ নিষ্ঠুর সত্যটি প্রকাশ করলেন-”
ফুটপাতে চিৎকাত ঘুমের শরীর
রাতপাপী ভেঙে দেয় ঘুম সোহাগির।”(পৃষ্ঠা-৩০)
দাম্পত্য জীবন ভালোবাসার একাগ্রতা ও আন্তরিকতা সুখের চাবিকাঠি।তার ব্যত্যয় ঘটলে অর্থাৎ কেউ বহুপথে বহুগামী হলে সুখের নীড়ে সংশয়ের আবর্ত সৃষ্টি হয়,যার পরিণতি দাম্পত্য জীবনের জন্য মোটেই শুভ হয় না-
“বহুপথে বহুগামী জীবনের ক্ষয়
মায়ানীড় পরিবারে থাকে সংশয়।” (পৃষ্ঠা-৩৯)
স্যালোফোনে উড়াল ও কৃত্রিম বহুগামী ভালোবাসার কথাও কবি বলেছেন; যার শিকার বর্তমান প্রজন্ম-
“স্যালোফোনে উড়ে যায় ভালোবাসা গেম
একটার পরে আসে আরেকটা নেম।” (পৃষ্ঠা-২০)বেকার সমস্যা বড়ো সমস্যা। বেকারের কষ্ট ও ওঠে এসেছে কবির কলমে- “বেকারের পায়ে চষে হেলাফেলা দিন
ভুলে ভুলে জমে সুদ বেদনার ঋণ।” (পৃষ্ঠা-১১)
চৈত্রের খরায় কৃষকের দুঃখ ও ক্ষতির চিত্রায়ণ করেছেন কবি এভাবে-”
“চৈতালিয়া রোদ খোঁজে জমিনের ফাঁক
জলচোখে দমে যায় কৃষকের বাক।” (পৃষ্ঠা-১৫)
উৎকোচের বিরুদ্ধে কবি সোচ্চার-
“চাকরির বাঁকে বাঁকে প্রথাটাই দোষী
ঘুসপ্রীতি নীতি নাশে তবু তারে পোষী।” (পৃষ্ঠা-৩৫)
অর্থাৎ চাকুরীর সর্বক্ষেত্রেই প্রথাটা মন্দ হলেও উৎকোচ রয়েছে।তা নীতিনাশক হলেও সবাই এই উৎকোচ প্রথাকে লালন করেন।ভূমি-খেকোদের প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর কবিতায়-
“ভূমিখেকো ভূমি চোর করে ভূমি চুরি
নিজ ভূমি সাড়ে তিন মেকি জারিজুরি।”
(পৃষ্ঠা-৩২)
মানুষের কবরের জন্য মাত্র সাড়ে তিন হাত ভূমি প্রয়োজন,জাল জোচ্চুরি তথা জারিজুরির কী প্রয়োজন।
(তিন)
গ্রন্থের অনণু-কবিতাগুলো পাঠ করে প্রতীতি জন্মেছে যে,আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ জাত- কবি।এই ছোট ছোট কবিতাশ এতো দর্শন,এতো জল,এতো গভীরতা আমাকে জলময় করে তুলেছিলো। তিনি এতো সুন্দরভাবে স্বদেশ,জীবন,প্রেম-প্রকৃতি ও জীবনের অনেক অসঙ্গতিকে ছোট কৌটায় ভরে আমাদের জন্য নিয়ে এসেছেন।তা তাঁর মতো একজন পরিপক্ক ও দক্ষ শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব।তাঁর ছন্দ-মাধুর্য নিয়ে ই প্রত্যেকটি অণু-কবিতা এক একটি পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবিতা।উপমা ও উৎপ্রেক্ষা যুৎসই ও যথাযথ।কাব্যাঙ্গন তাঁকে চায়।
মুহম্মদ আব্দুল হান্নান
কবি ও সাবেক ব্যাংকার।