আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ ও তাঁর ঢিলেকাব্য
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:৪১ মিনিট
শামসুল করিম কয়েস :
কবিতা কবির নান্দনিক চেতনার ফসল।কবির অন্তর ভাবনাকে জারিত করেই কবিতা শিল্পরূপ লাভ করে।তাই একেক মানুষের চিন্তা-চেতনার স্বরূপ যেমনি স্বতন্ত্র,তেমনি কবিদের কাব্যভাবনার প্রকৃতিও স্বতন্ত্র।কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ ও স্বাতন্ত্রিকদের একজন।নব্বই দশক থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু।একজন তরুণ প্রবন্ধকার ও সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন।প্রফেসর মোঃ আব্দুল আজিজ আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র ঢিলেকাব্য সম্পর্কে লিখেছেন-
“এ গ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাগুলো নিঃসন্দেহে ছন্দবদ্ধ,কিন্তু নতুনত্ব রয়েছে।এর আকারে…রবীন্দ্রনাথের লেখনে এ ধরনের কিছু পঙ্ ক্তিমালা রয়েছে-যা দ্বিপদী আবার পঙ্ ক্তিমালা ভেঙ্গে চতুষ্পদীও করা যায়।ঢিলেকাব্যের পঙক্তিমালাগুলোকেও সেভাবে সাজানো যেতে পারে।তবে আকারটা এ ক্ষেত্রে মুখ্য নয়-আসল বিবেচ্য এর ভাব।ঢিলেকাব্যের পঙ্ ক্তি মালায় কবির জীবনবোধ,অভিজ্ঞতার নির্যাস ও সূক্ষ্ম রসবোধের প্রকাশ ঘটেছে।মাত্র দু’টি লাইনের পরিসরে একটি বড়ো ভাবের প্রকাশ ঘটানো সত্যিকার কবিপ্রতিভার পরিচায়ক।”
(কথালতা-১৪,প্রকাশকাল ১৫ সেপ্টেম্বর-২০০৯)
শুধু তাই নয়,আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ সম্পর্কে কবি মুহম্মদ আবদুল হান্নান লিখেন-“গ্রন্থের অণু-কবিতা গুলো পাঠ করে প্রতীতি জন্মেছে যে, আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ জাত-কবি।তাঁর এই ছোট ছোট কবিতায় এতো দর্শন,এতো জল,এতো গভীরতা,আমাকে জলময় করে তুলেছিলো।তিনি এতো সুন্দরভাবে স্বদেশ,জীবন,প্রেম-প্রকৃতি ও জীবনের অনেক অসঙ্গতিকে ছোট কৌটায় ভরে আমাদের জন্য নিয়ে এসেছেন।তাঁর মতো একজন পরিপক্ক ও দক্ষ শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব।তাঁর ছন্দ-মাধুর্য নিয়েই প্রত্যেকটি অণু-কবিতা।এক একটি পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবিতা,উপমা ও উৎপ্রেক্ষা যুৎসই ও যথাযথ,কাব্যাঙ্গন তাঁকে চায়।”(দৈনিক সিলেটের ডাক ২৩ ডিসেম্বর ২০২২)
তরুণ কবিদের মধ্যে আবিদ ফায়সাল আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে লিখেছেন “জীবনকে ছুঁয়ে-ছেনে দেখা কবির স্বভাব।আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র কাব্যে ও এই অন্বেষণ সুস্পষ্ট।জীবনের জোরই আলাদা।একটি অসাধারণ অভিজ্ঞান- “সহ্যের উপমা হও নিরেট আলোক
বশ করা মনটাই দেহের চালক।”
তাঁর পঙ্ ক্তিগুলোতে এভাবে লুকিয়ে আছে প্রাসঙ্গিক সব সংকেত এবং নিজস্ব দর্শন।…তাঁর কবিতার বিষয় ও ভাবনা সমাজ,জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে।”
(দৈনিক যুগভেরী-৯ মার্চ ২০০৯) নাজমুল আনসারী লিখেন-“নব্বইয়ের প্রতিভাবান তরুণ প্রবন্ধকার শূন্য দশকের প্রতিশ্রুতিশীল কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র প্রথম সৃষ্টিচিহ্ন ঢিলেকাব্য প্রচলিত কাব্য প্রকাশনার চেয়ে নিতান্তই একটি ব্যতিক্রমধর্মী শক্তিশালী কাব্য সৃজন।…শুরু থেকে শেষ অবধি (৮+৬)=১৪ মাত্রার সফল স্বরাক্ষরিক ছন্দের চাল প্রতিটি দ্বিপদীতে লক্ষণীয়।অন্তমিল,অনুপ্রাস,উপমা ও ইঙ্গিত ভাষাকে বহুমাত্রিক মাধুর্যে সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় করেছে নিঃসন্দেহে।…প্রতিটি দ্বিপদীতে আছে একেকটি ম্যাসেজ বা লেসন।”
(দৈনিক সিলেটের ডাক-১১ অক্টোবর-২০০৯)
আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকাল ১০ টা ৪৫ মিনিটে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৬ নং ওয়ার্ডের ইলাসকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া ও মা নেহারা খাতুন আসিয়া।এম.সি কলেজ সিলেট থেকে স্নাতকোত্তর লাভ করে একটি প্রাইভেট ব্যাংকের কর্মকর্তা।১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে লেখালেখিতে হাতেখড়ি।তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ঢিলেকাব্য।
ঢিলেকাব্য গ্রন্হে কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ জীবনাভিজ্ঞতা থেকে বিচিত্র কাব্যোপকরণ সংগ্রহ করে একটি অখণ্ড শিল্পরূপ দান করেছেন। খন্ডচিত্রের কোলাজ সংযোজনে একটি অখণ্ড কাব্য ভাবনায় উন্নীত হয়েছে।১৪ মাত্রা বিশিষ্ট পয়ার ছন্দে রচিত প্রতি পৃষ্ঠায় ৬টি চরণে ৩টি করে দুই লাইনের পয়ারে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কবির কাব্য ভাবনাকে।গ্রন্থের প্রথম পয়ারটির বিষয়বস্তু হচ্ছে আমাদের সংসারের সবচেয়ে আপন দু’জন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে।
মা আমাদের সংসারের সবচেয়ে শান্তিময় আশ্রয়স্থল এবং বাবার স্নেহের যেন কোনো পরিসীমা নেই। কবিতার ভাষায় বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে চমৎকার ভাব-ব্যঞ্জনায়-
“মা’র মন মায়াময় ছায়াময় ছাদ
বাবা’র প্রেমের মাঝে নেই অবসাদ।”
গ্রন্হের দ্বিতীয় পয়ারটির বিষয় স্বদেশ প্রেম।কবি হৃদয়ে স্বদেশ প্রেমের আবেগ সদা জাগ্রত স্বদেশের প্রতি কবি অনুভব করেন সুগভীর ভালোবাসা,তাই তিনি খুব ভোরে নিদ্রাভঙ্গের পর দৃঢ়কণ্ঠে স্বদেশের ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করেন।কবিতার ভাষায়-
“ঘুম জেগে প্রতিদিন বলি খুব ভোরে
প্রাণের স্বদেশ ভূমি ভালোবাসি তোরে।”
গ্রন্থের একটি পয়ারে আইনে অপরাধীর জামিন দেওয়া সম্পর্কে কটাক্ষ করা হয়েছে।যারা অপরাধ করে তাদের গ্রেফতার করে বিচার করা আইনের কাজ।কবি প্রত্যক্ষ করেছেন যে,আইন অপরাধীকে গ্রেফতার করলেও টাকা হলে সে জামিন নিতে পারে এবং টাকার বিনিময়ে যেন সবকিছু করতে পারে।পয়ারের ভাষায়-
“আইনের দড়ি বাঁধে অপরাধী-হাত
টাকা হলে জামিনের নেই জাতপাত।”
কবিরা কবিতা রচনা করে অন্তরের উপলব্ধিকে কাগজের বুকে কলম দিয়ে লিখে।কবিরা কল্পনার জগৎকে শব্দের সুষমা প্রয়োগের মাধ্যমে কবিতায় রূপ দেন।কাব্য-ভাবনায় ধ্যান-নিমগ্ন কবি রাতের নিস্তব্ধতায় কবিতার রচনার সৃজনশীলতার সুখ অনুভব করেন।কবির ভাষায় বিষয়টি চমৎকার কাব্যরূপ লাভ করেছে যেমন,
“কাব্যের কবুল পড়ে কলমের মুখ
রাত গিলে কবি বলে এই তার সুখ।”
গ্রন্হের একটি পয়ারে বেকারদের সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।ব্যক্তির কর্মস্পৃহার অভাবেই ব্যক্তি বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত হয়।কারণ তারা সময় থাকতে সময়ের সঠিক ব্যবহার করে না।হেলাফেলায় দিন কাটিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করে।নিজেকে কর্মদক্ষ করতে পারে না।এর ফলশ্রুতিতে তাদের জীবনে সঞ্চিত হতে থাকে দুঃখ কষ্টের বোঝা।পয়ারের ভাষায় কবি এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি পরিবেশন করেছেন।যেমন-
“বেকারের পায়ে চষে হেলাফেলা দিন
ভুলে ভুলে জমে সুদ বেদনার ঋণ।’
সমাজের অনেক পরিবার আছে যারা ঋণ করে ছেলে মেয়ের বিয়ের উৎসবের আয়োজন করে থাকে ধুমধাম করে।এ ধরনের আয়োজন করা হলে উৎসব হয় ঠিকই কিন্তু উৎসব পেরিয়ে গেলে সেই ঋণের যন্ত্রণা শুরু হতে থাকে।ক্রমেই তা চরম অশান্তিতে পরিণত হয়।বিষয়টিকে কবি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন-
” বিয়েবাড়ি বিয়ে ধুম দেনা করে হলে
পলে পলে বাড়ে সুদ ভালোবাসা টলে।”
বাংলা প্রবাদে আছে ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি।’এই তত্ত্বকথাটিই কবি কাব্যিক রূপদান করেছেন একটি পয়ারে,যারা চালাকি করে অন্যের ক্ষতি করে নিজেকে লাভবান ভাবে; তাদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় সব সময় থাকে।কারণ তারা নিজের অপকর্ম সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকে। তাদের ভয় থাকে কখন যে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ে এবং একসময়ে সত্যিকারেই সে সবার কাছে ধরা পড়ে যায়।কবি বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন পয়ারের ছন্দবদ্ধ তায়।যেমন-
“চালাকের অতি চালে মৃদু সংশয়
ছয়দিন চালাকির একদিনে ক্ষয়।” সংসারে যে যেমন সবার সাথে আচার- ব্যবহার করে;সেও তেমন অন্যের কাছ থেকে প্রতিদান পায়।অপরকে ভালোবাসলে,সে নিজেও অপরের ভালোবাসা পাবে;এটাই জগতের নিয়ম।আবার অপরকে ঘৃণা করলে, সে ও একদিন ঘৃণার পাত্র হবে;এটাই স্বাভাবিক।
কবি এই সহজ সত্যকে তুলে ধরেছেন একটি পয়ারে।যেমন-
“হাসি দিয়ে হাসি কেনা জগতের ধর্ম কেনাবেচা এই গুণ সংসার-বর্ম।”
জীবন সবসময় একই ধারায় বহমান হয় না।জীবনাঙ্গনে কখনো আসে উত্থান,কখনো বা পতন।এই নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়,জীবনকে যাপন করতে হয়।কেউ যদি জীবন থেকে শুধুমাত্র আনন্দকে পেতে চায়;তাহলে সে অনিবার্যভাবেই ব্যর্থ হবে।আবার কেউ যদি মনে করে তার জীবন চিরকাল অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকবে, কোনোকালে আলো দেখা দেবে না, এটাও সত্য নয়।প্রকৃতপক্ষে ভালো-মন্দ দুটোকেই স্বীকার করে নিয়ে জীবন পথে এগিয়ে যেতে হয়। এই তত্ত্বটি সুন্দরভাবে পয়ারে ছন্দময় হয়ে উঠেছে।যেমন-
“জীবনের বাঁকে বাঁকে আসে কাদা জল
এই নিয়ে সুখে থাকা হোক চলাচল।” এভাবেই ঢিলেকাব্য গ্রন্থে কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ তাঁর জগৎ -জীবন সম্পর্কিত আত্মদর্শনকে পয়ারের ছন্দোবদ্ধতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।বলা যায়-গ্রন্থের প্রতিটি পয়ার বা দ্বিপদী কবির জীবনা
ভিজ্ঞতার ফসল।বিশেষত কবি উপমা প্রয়োগের মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষয়ের মনঃস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন;যা গ্রন্থটিকে ব্যতিক্রমধর্মী শিল্পসফলতায় উন্নীত করেছে।কবি আনােয়ার হোসেন মিছবাহ্ বাংলা কাব্যাঙ্গনে নিরীক্ষাধর্মী কবি হিসেবে তাঁর ‘ঢিলেকাব্য’ গ্রন্হে স্বাতন্ত্র্য কবি- প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।’বনসাই প্রকাশন’ থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৯ সালে প্রকাশিত ৪০ পৃষ্ঠায় মোট ১০৮ টি অনুকবিতা বা পয়ার দিয়ে সাজানো হয়েছে।বিষয় হিসেবে এসেছে স্বদেশ,প্রেম,সংস্কৃতি ও সমাজ চিন্তা।এই গ্রন্থটির সুদৃশ্য প্রচ্ছদ ও রেখাঙ্কন করেছেন শিল্পী ইসমাইল গনি হিমন।