প্রেমের প্রাবল্যে জীবনের আখ্যান
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:৪৭ মিনিটনাজমুল আনসারী :
তিনি লিখে চলেছেন নিরন্তর সেই নব্বইয়ের দশক থেকে অদ্যাবধি। গান, গল্পসহ সাহিত্যের অপরাপর শাখায় বিচরণ করলেও মূলত তিনি কবি। তাঁর কবিতায় গার্হস্থ্যপ্রেমের রোমান্টিক প্রস্রবণই সমধিক লক্ষণীয়। তাঁর প্রতিটি কবিতা যেনো প্রেমের প্রাবল্য মাখা আত্মজৈবনিক আখ্যান। জীবনকে তিনি প্রেমিক চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর গল্প, প্রবন্ধ কিংবা গানের প্রতিটি শব্দের কারুকাজে বোনেন কবিতার ভাব বিশ্ব। ভাব, ভাষা ও ছন্দের নিপুণ কারিগর এই সৃজন শিল্পী আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ যিনি ‘ঢিলেকাব্য’ নামক ১৪ মাত্রায় স্বর ও অক্ষর কে মাত্রায় যুক্ত করে স্বরাক্ষরে কাব্য রচনার মাধ্যমে কাব্যাঙ্গনে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আঙ্গিকের কবিতা নিয়ে পাঠক পাড়ায় সাড়া জাগান।
‘ঢিলেকাব্য’ গ্রন্থে রচিত ১০৮ টি কবিতা থেকে কয়েকটি কবিতা তুলে ধরলেই এর ন্যায্যতা পরিস্ফুট হবে বলে মনে করি। যেমন তিনি লেখেন-
“মা’র মন মায়াময় ছায়াময় ছাদ/ বাবা’র প্রেমের মাঝে নেই অবসাদ।” (পৃষ্ঠা-৫)।
“নরপশু খুলে নেয় যুবতীর গিঁট/ জোছনার আলো মাখে যুবকের পিঠ।” (পৃষ্ঠা-৯)
“মাদকের মাদকতা ক্ষণকাল বাঁচে/ দম্ নাচে কুছুদিন কালাসুখ টাচে।”
“স্বপ্নের চিবুক ছুঁয়ে জেগে ওঠে ঘুম/ চাপকলে ধুয়ে যায় মুছে যায় চুম।” (পৃষ্ঠা -১৫)
“প্রেমের আগুনে বুক ধিকিধিকি জ্বলে/ ফুসফুসে কানাপ্রেম নিকোটিনে গলে।” (পৃষ্ঠা-১৮)
“জীবনের বাঁকে বাঁকে আসে কাদা জল/ এই নিয়ে সুখে থাকা হোক চলাচল।” (পৃষ্ঠা-২৩)
“মন গলে পাম মুছে মোম গলে আগ/ ক্ষণ গলে শাপ মুছে দম গলে দাগ।” (পৃষ্ঠা-৩৫)
“প্রতিদিন ভালোবাসা হোক প্রতিবেশে/ গাছপালা পশুপাখি থাক মিলেমিশে।” (পৃষ্ঠা-৪০)
সে ই অনন্য পংঙক্তিমালায় সৃজনি শক্তির ঢিলেকাব্য (২০০৯) পরবর্তী প্রায় দশ বছর পরে তিনি এক ই বছরে ‘একবাক্স দীর্ঘশ্বাস’ ছেঁড়া পঙক্তি’ ও মনের মেঘে পাখনা মেলে’ শিরোনামের তিনটি চমৎকার কাব্যগ্রন্থ উপহার দেন। তাঁর তিনটি গ্রন্থ ই ব্যাপক আলোচনার দাবী রাখে। আমরা এখানে নতুন প্রকাশিত গ্রন্থত্রয়ীর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠপর্যালোচনা করার প্রয়াস পাবো।
একবাক্স দীর্ঘশ্বাস : কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ ‘র ইতোমধ্যে প্রকাশিত সবগুলো কাব্যগ্রন্থ ই বিষয়-বৈচিত্র, ভাষা ও আঙ্গিকের স্বকীয়তা বিদ্যমান। তবে একজন সচেতন কাব্যকর্মী হিসেবে তাঁর প্রতিটি কাব্য নিবিড় পাঠ পর্যবেক্ষণ পর প্রতীয়মাণ হয়েছে ‘একবাক্স দীর্ঘশ্বাস’ গ্রন্থটির কবিতাগুলো তে কবি সবচেয়ে বেশি শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। মোট ৯৬টি কবিতা নিয়ে সাজানো এই কাব্যে ছন্দবদ্ধ কবিতা যেমন রয়েছে তেমনি আছে মুক্তক ছন্দে রচিত আধুনিক অক্ষরবৃত্তের কবিতা। বইটির প্রায় প্রতিটি কবিতা ই শিল্পকুশল কাব্যভাষায় স্বনির্মিত। বাঁকভঙ্গির চমৎকারিত্ব ও নাটকীয় প্রক্ষেপণ, কাব্য ভাবনা ও কাব্যাঙ্গিকের কুশলি বিন্যাস স্বপ্ন ও সৌন্দর্যবোধ, প্রতীক ও রূপকের ব্যবহারে অনুপম অভিনবত্ব, উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের সঞ্জিবনী শক্তি কবিতাগুলোকে উচ্চ মাত্রা দান করেছে। যে কবিতাগুলো আমার নিউরণে নিবিড়ভাবে আলোড়ন সৃষ্ঠি করেছে সেগুলো হচ্ছে-
ফিরে আসা, শিথানে পরান বান্ধী, কোনও অরণ্যে, নিষিদ্ধ ফরিয়াদ, অন্ধরাতের অঞ্জনা, মানব মাটি, কৃষ্ণরাঙ্গি ঝপ্ তারা, বেগানা শিল্পের জন্য, ছুটি, প্রার্থনা, ইরার মুখ, বিশ তারিখের দিন এবং বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।
‘ফিরে আসা’ একটি ছোট্ট আঙ্গিকের অক্ষরবৃত্তে রচিত আধুনিক কবিতা। কবিতাটিতে কবি জীবনঘনিষ্ট সত্য উচ্চারণ করেছেন।
‘দুঃখ এবং কষ্ট মানবজীবনের দুটি বাস্তব অনুষঙ্গ, তবে জীবন তাতে ই থেমে থাকে না। দুঃখ কষ্ট কে মেনে নিয়ে কিংবা মানিয়ে নিয়ে মানুষকে ফিরে আসতে হয় জীবনের পথে। জীবন থেকে নেওয়া এই অভিজ্ঞতা কবি চিহ্নিত করেছেন চমৎকার কাব্যশৈলিতে-
“দুঃখদের বাড়ি দাওয়াত ছিল গতকাল। / আমি রেললাইনের স্লিপার গুনছিলাম/ আর হাঁটতে হাঁটতে দাওয়াতে যাচ্ছিলাম/ অমনি সমুখ থেকে একজন কষ্ট এসে বললেন;/ কোথায় যাচ্ছো হে মহান পুরুষ? (পৃষ্ঠা-২০)
‘একবাক্স দীর্ঘশ্বাস’ গ্রন্থের নামকরণের স্বার্থকতা খুঁজে পাই ‘শিথানে পরান বান্ধী’ কবিতায়। কবিতাটিতে কবি হৃদয়ের হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। প্রেয়সীর প্রস্থানে কবির পরানে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর অন্তর মনে ক্যামুন যেনো ধড়ফড়ানি লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি চরণে ষোল মাত্রায় বিন্যস্ত ছয় চরনের ছন্দবদ্ধ এই কবিতাটি ছোট্ট আঙ্গিকের হলেও প্রেমিকার জন্যে কবির দীর্ঘশ্বাসটি অনেক ঘনিষ্ঠ। কবিতায় দীর্ঘশ্বাসের নমুনা-
“আজন্ম পিয়াসী আমি শিথানে পরান বান্ধী/ কই যাও গো প্রেয়সী আমারে রাইখা বন্ধি/ বুকডা ফাডায়া চাও ক্যামুন ধড়ফড়ায়/ রক্তের মুমূর্ষুতায় জীবনডা ক্ষয়ে যায়/ ওগো পরানের নদী আমারে যে-ও না ছাড়ি/ আমি যে বাইছা আছি শিথানে পরান বান্ধী।” (পৃষ্ঠা -২৩)
‘নিষিদ্ধ ফরিয়াদ’একটি দীর্ঘ আঙ্গিকের স্বর বৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতা। এই কবিতায় কবি ছন্দে ছন্দে একজন বিবাহিত রমনীর বুকচাপা ব্যথা,মুখচাপা কথা প্রবাসী স্বামীর নিকট একজন বিদেশগামী আত্মীয়ের মাধ্যমে অকপটে ব্যক্ত করেছেন। এই কবিতায় কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ আমাদের সমাজের বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের হাজার হাজার রমনীর মনের কথা অত্যন্ত কাব্যিক মুন্সিয়ানায় উপস্থাপন করেছেন। কবিতাটির কিয়দংশ-
“পাষাণ পাষাণ ওরে পাষাণ যা দেখে যা এসে/ তোর পরানে আছাড় খেয়ে রলাম পড়ে দেশে/ রাত প্রতিরাত বুক ভেসে যায় বালিশ চোখের জলে/ পাষাণ তোরে পাবো কি আর প্রেমের ছলে বলে। / আবুল মামা কাবুল হয়ে যাবেন না কি দুবাই/ এই কথাটি শোনার পরে স্বপ্ন আমি চুবাই/ রাত্রে ঘেঁষে বসে পড়ি আবুল মামার পাশে-/ তুমি তো কাল যাচ্ছো কাবুল দুবাই পরের মাসে/ আবুল মামা জানের মামা ধরছি তোমার পায়ে/ পাষাণটারে দেখতে দিও তোমার কোর্টের রায়ে। ” (পৃষ্ঠা -৪০)
আবার নারীর দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ‘অন্ধরাতের অঞ্জনা’ কবিতায় বলেন-
“আমরা তো ভাই আলগা মানুষ ভদ্দলোকের রঞ্জনা/ ঘুম তাড়ানো পায়রা কুসুম অন্ধরাতের অঞ্জনা/ এই তো সেদিন যা ছিল সব একটা নিছক কল্পনা/ শুনতে থাকুন আমার কথা একটুও তা গল্প না/ ভাবতো কে আর এমনভাবে বাড়বে পেটের যন্ত্রণা/ কাতর খিদায় পা রেখেছি দেয়নি তো কেউ মন্ত্রণা।” (পৃষ্ঠা -২৮)
কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র একটি ভিন্ন গঠনশৈলী ও ভিন্ন বক্তব্যের কবিতা ‘মানব মাটি’। স্বল্প শব্দে নিরীক্ষাধর্মী আঙ্গিকে পুরো মানবজীবনের একটি কালচিত্র অঙ্কন করেছেন। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সাতটি ধাপে তিনি জীবনের গল্প বলেছেন।
কবিতাটির নামকরণ, শব্দচয়ন, প্রতীকি ভাষা সবকিছু মিলে একটি আলাদা স্বর ও মাত্রা পরিলক্ষিত হয়েছে। মাটি দিয়ে তৈরি মানুষ জীবন শেষে মাটিতেই পতিত হয়। মাটির সাথে মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য-যা কবিতায় ফুটে উঠেছে। কবিতার প্রথম ও শেষ স্তবক ঃ
“নবজাতক/ ক্রন্দন/ দুধ/ স্যাভলন/ ব্লেড/ গিটট্টু।
বংশধর/ হা-হুতাশ/ পাকা চুল/ বার্ধক্য/ ধবল শাদা/ বাঁশ/ কবর/ কঙ্কাল/ মাটি।” (পৃষ্ঠা-৪৩)
উপমা কবিতার একটি অনন্য উপাদান- যা কবিতাকে করে আকর্ষণীয়, কাব্যিক ও মানোত্তীর্ণ। পৃথিবীর প্রায় বিখ্যাত সকল কবি ই তাঁদের কবিতায় উপমা প্রয়োগ করেছেন। ‘কৃষ্ণরাঙ্গি ঝপতারা ‘একটি অনবদ্য উপমা প্রধান কবিতা। স্বতঃস্ফূর্ত ও সার্থক কিছু উপমা কবিতাটিকে অন্যরকম ব্যঞ্জনা দান করেছে। যে উপমাগুলো বলার লোভ সামলাতে পারছি না- সেগুলো হলো ঃ
“ভাবছি তোমার গাল থেকে/ ঝপ্ করে নিয়ে নেবো কৃষ্ণরঙের তারাটি”/ এবার বাদুড়ঝোলা হাসি আসে মুখ ভরে ভরে/ হাসতে হাসতে জৈ ষ্ঠী আমের মতোন রস ঠসঠসে/ বিনিয়ানা চেরামুখে বলে;”
“গাভিন গাঙের ঘোলাজলে কতই তো থাকে নাড়িংবিড়িং/ খুঁজে কি তাদের জালোয়ারা ফেলে জাল” (পৃষ্ঠা -৫৮)
উপরোক্ত চরণগুলোতে ব্যবহৃত ‘কৃষ্ণরঙের তারা’, বাদুড়ঝোলা হাসি’বিবিয়ানা চেরামুখ’এবং ‘গাভিন গাঙের ঘোলাজল’ ইত্যাদি উপমাগুলো কবিতার নান্দনিকতাকে উচ্চকিত করেছে। কৃষ্ণরাঙ্গি ঝপতারা কবিতার পরেও কাব্যগড়ন বাক্যশৈলীর আরও কিছু উদাহরণ আমাকে মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে রাখে। তাঁর বইয়ের পরতে পরতে এ রকম শব্দ তুলে আনা যাশ এভাবে- ‘টপকা ডিঙান’, মৃত্যুর লোবান, আয়নার আঁকশি, স্মৃতিদাগ মায়া, ঘুম বিনাশীর আয়ুর কলস, বিবস্ত্র চাঁদ, সিগারেটের ফিল্টার ছোঁয়া রাতে, কাদাজলে কাদাখোচা শ্রমিক, নিষেধের ব্যালকনি, হুক করিগর, শিথানে পরান বান্ধী, রাতসিঁথিতে, সপুর বেলা, দুকেল বেলা, কেলসন্ধ্যা, আলাফলি প্রেম, অন্ধরাত, পোয়াতি দ্বিপ্রহর, তৃষাতুর অনলের, লেডিকুত্তা, ঊর্মিলা মনের বিন্দু, বেহালা গুহায়, দুর্যোগকালীন উদরের ত্রাণ, বাঁশের উদরে মালিকের মাসিক খোঁজাখুঁজি, কন্ধর শরীর, স্বরোজ পাহারা, তন্দ্রাকিশোরী, বাউরা বেঘোরে, কুসুমে অস্থির, পায়জামা খিলে,
জৌলসী আড্ডা, বিড়িটানা ভোরে, ন্যাড়া টয়লেট, কৃষ্ণচূড়া জীবন, রিপাবলিক শাদা হাউস, লুঙ্গিকাছা নথিক মানুষজন, পিরিতির হুকের কসম, গোশতের ছুরি, মেয়েলোকের মদিরাক্ষিতে, ফোর্সের কুত্তার মতো, সায়ানাইড চিৎকার, কুত্তাকুমারীর গলায়, বেগানা শিল্প, ভেজা শ্রমের লিজ, ভংবৈষ্ণব, বাজুবেড়, দোরহি হৃদয়, একবাক্স দীর্ঘশ্বাস, রাত্রিচারীর চোখ, বেতনের কারিগর, বেঘোর বিদ্রোহ, ইজারের খপ্পর, লবনের ঢেউ, সুঘ্রাতা স্নেহ, শরমিন্দা দিনে বেপর্দা সময়, শৌখিন জমিন, নোনা সুর, শ্বাসবাতি, জোছনামাখন ইত্যাদি শব্দে বোনা কারুকাজে বইয়ের জন্মকে স্বার্থক করেছে।
“হৃদয় ছুটিতে গেলে/ রেললাইনের পাত গুনে গুনে/ দুই ইঞ্জিনের পিছু হাঁটি।
একদিন, আবেদন জেগে উঠে বলে;/ ছুটি শেষে হৃদয়ের ফেরা হবে/ যদি পাঁজরের দ্বার খোল তবে।” (পৃষ্ঠা -৭৭)
উপরের কবিতাংশ ‘ছুটি’ কবিতার প্রথম ও শেষ স্তবক। এটি একটি বিরহী প্রেমিক হৃদয়ের নষ্টালজিক বয়ান। কবিতাটিতে কবি তাঁর কাক্সিক্ষতজনকে না পাওয়ার বেদনায় ব্যথিত হয়ে হৃদয়কে ছুটিতে পাঠিয়েছেন এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন-যদি তাঁর মানসপ্রিয়া পাঁজরের দরজা খোলে দেন তবে, তিনি হৃদয়ের ছুটি বাতিল করে ফিরে আসবেন। কবিতাটির নির্মেদ বাক-রীতি ও চিত্রকল্প প্রশংসার দাবী রাখে।
‘একবাক্স দীর্ঘশ্বাস’র বেশিরভাগ কবিতাই নারী প্রেম সংশ্লিষ্ট। বিষয়বস্তুর দিক বিবেচনায় প্রার্থনা কবিতাটি একটি ব্যতীক্রমধর্মী আধ্যাত্মিক স্বরের পরিবাহি। মাত্র দুই স্তবকে বিন্যস্থ ক্ষুদ্র আঙ্গিকের এটি একটি ছন্দ নির্ভর কবিতা। এখানে কবি বেশ শিল্প কুশল ভঙ্গিতে যৌবনের অনাকাক্সিক্ষত কৃতকর্মের জন্যে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে মাফি কামনা করেছেন। কবিতার প্রথম স্তবক:
“জীবন আমার দিলাম দয়াল/ যৌবন দিলাম পাপ কাজে/ তোমায় আরজ করছি দয়াল/ চাই গো পাপের মাফ লাজে” (পৃষ্ঠা -৯৭)
সন্তানের প্রতি মাতাপিতার প্রেম নিখাদ ও নিঃস্বার্থ এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত যতো নিয়ামত আছে তার মধ্যে সন্তানসন্ততি একটি অন্যতম নিয়ামত।
যারা সন্তান লাভ করেছেন তারা খুব ভালোভাবে অনুভব করতে পারেন সন্তানের সুখ, স্নেহ, ভালোবাসার গভীরতা। সন্তান যখন পৃথিবীতে আসে তখন মা বাবার আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ তাঁর ‘একবাক্স দীর্ঘশ্বাস’কাব্যে-‘ইরার মুখ’, ’সাত তারিখের দিন’, ’প্রেম সোহাগের ঋণে, ’বয়েস হলো চার’ এবং ‘বিশ তারিখের দিন’শিরোনামীয় মোট ৫ টি কবিতা তাঁর দুই কলিজার টুকরো জয়িতা হোসেন ইরা এবং আয়ান হোসেন জয়কে নিয়ে রচনা করেছেন। ৫টি কবিতাই আদরের সন্তানদের প্রতি বাবার একবাক্স ভালোবাসা। ছন্দের তালে তালে সাজানো এই ৫টি কাব্যফুলের প্রতিটি পাপড়িতে যেনো ঝরে পড়েছে অকৃত্রিম প্রেমের পরশমাখা রেণু। কবিতাগুলোতে কবি নিজে সরাসরি বক্তব্য না দিয়ে সন্তানদের মুখনিঃসৃত কথামালাকে কাব্যিক কারুকার্যে নির্মাণ করেছেন সুনিপুণ হাতে। ৫টি কবিতার কয়েকটি চমৎকার চরণ:
“আশিশ দেবেন সবাই আমায় বাঁচবো মহাসুখে/ অট্টহাসির মাঝেও আমি কাঁদবো সবার দুখে” (পৃষ্ঠা-১০৩)
“নামটি আমার শোনাই শুনুন জয়িতা হোসেন ইরা/ আশিস হলো আমার কাছে লক্ষ কোটি হীরা।” (পৃষ্ঠা-১০৪)
“আব্বু আমার সাথি হলে স্পর্ধাটা যায় বেড়ে/ দুষ্টু দমন করতে আমি যাই চরাচর তেড়ে/ তিন ছাড়িয়ে আমি হবো অনেক বড়ো কিছু/ জয়িতা হোসেন ইরার দলে সবাই নেবে পিছু।” (পৃষ্ঠা -১০৫)
“আদর করে সবাই ডাকেন আয়ান হোসেন জয়/ সবার আশিস নিয়ে যেন দূর করি সব ভয়।” (পৃষ্ঠা -১০৭)
বইটির সবশেষে সংযুক্ত ‘বন্ধুরে নয়ত তুমি পর’ কবিতাটি সবচেয়ে দীর্ঘাঙ্গিকের একটি অনবদ্য গীতিকবিতা। ভাব, বিষয় এবং ছন্দে সকল দিক বিবেচনায় আমার মতে কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র এটি একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। সিলেটের পর্যটন স্থানকে চিহ্নিত করে তথ্যচিত্রের বাঙময় বয়ানে এমন শিল্প সুষমার কবিতা বিধৃত করে ভ্রমণ পিয়াসীদের ভ্রমণকে উসকে দিয়েছেন বলে ভাবা যায়। তাঁর এই রচনা হয়তো কোনদিন পর্যটকদের কাছে রেফারেন্স হয়েও সঙ্গীন হতে পারে।
আর কোন কবিতা যদি কোনদিন কথা না ও বলে;এই কবিতাটি মিছবাহ্ কে স্মরণ করিয়ে দেবে। কাব্যজগতে চিহ্নিত করে রাখবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। ইতিমধ্যে কবিতাটি আবৃত্তির পুরো অংশ ইউটিউব চ্যানেলেও দেখতে এবং শুনতে পাওয়া যায়।
বন্ধুকে সন্মোধন করে সৃষ্ট এই কবিতাটির বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের পূণ্যভূমি হিসেবে খ্যাত কবির নিজ জেলা সিলেটকে। মোট ৩০টি ছন্দবদ্ধ স্তবকে সাজানো এই কবিতাটি মূলত গানের ব্যাকরণে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রতিটি স্তবকের প্রথম ও দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ও পঞ্চম পঙক্তিতে শক্তিশালী অন্তমিল দিয়েছেন মিছবাহ্। বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল অনুষঙ্গ স্থান পেয়েছে বইখানায়। কবিতাটি বিশদ আলোচনার দাবী রাখে। ক্ষুদ্র পরিসরে এইটুকুই বলতে চাই-‘বন্ধুরে নয়ত তুমি পর’কবিতাটি কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র একটি অসামান্য সৃষ্টি, অসাধ্য সাধন।
কবিতার কয়েকটি চমকপ্রদ চরণ ঃ
“কোথায় আছো বন্ধু তুমি/ এসো বন্ধু সিলেট ভূমি/ পূণ্যভূমি সিলেট আছে/ শাহজালালের ঘর।/ বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।”
“টাঙ্গুয়া ও শনির হাওরে/ বর্ষা শীতে তুমি আওরে/ নয়ন জোড়া আফাল দেখে/ মনের মাঝে ধর।/ বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।”
“গানের রাজা হাসন রাজা/ গান দিয়ে দিল করেন তাজা/ তাঁর গানের সব তাজা কথায়/ ভরে রে অন্তর।/ বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।”
“মণিপুরি খাসিয়া পাত্র/ আমরা সবার এ কি গাত্র/ মিলেমিশে থাকি সবাই/ কেউ ভাবে না পর।/ বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।” (পৃষ্ঠা-১০৮)
“চাশনিপিরের মাজার দেখি/ ভেবো না গো এসব মেকি/ গাছগাছালির বানরগুলো/ কেউ ভাবে না পর।/ বন্ধুরে নয়ত তুমি পর। ”
গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে/ ঘুরে ফিরে নানান রঙে/ দেখবো পাথর সারি সারি/ ঝুলছে বাড়িঘর।/ বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।” (পৃষ্ঠা -১০৯)
“ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর/ সারা স্বদেশ লোভে কাতর/ এই দিয়ে হয় সৌম্য বাড়ি/ সুখের একটি ঘর।/ বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।”
“বিছনাকান্দি বিছনা পাতা/ নয় সেখানে বালিশ কাঁথা/ জলের বুকে হেলান দিয়ে/ একটু শুয়ে পড়।/ বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।”
“রাতারগুলের আয়না জলে/ মন গলে আর পরান গলে/ একা হলেও গভীর বনে/ লাগে না ভয় ডর। / বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।” (পৃষ্ঠা -১১১)
“শাহপরানের আবাসভূমি/ গৌড়গোবিন্দের টিলা চুমি/ বইয়ের পোকা মানুষগুলোর/ কেমুসাসের ঘর। / বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।”
“বাংলার ম্যাপের উত্তর-পূর্বে/ যেদিকে না সূর্য ডুবে/ দেখবে আমি অপেক্ষা তে/ তোমার বন্ধুবর।/ বন্ধুরে নয়ত তুমি পর।” (পৃষ্ঠা -১১২)
ছেঁড়া পঙক্তি এবং মনের মেঘে পাখনা মেলে:
প্রেম কবিতার এক প্রধান উপাদান যা পৃথিবীর প্রায় সকল কবির কবিতায় প্রবলভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। প্রেম শুধু কবিতা নয়, মানুষের জীবনেরও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ-যা ব্যতিত জীবন প্রাণহীন, অচল। প্রেম কেবল একজন নারী ও পুরুষের মনো-দৈহিক সম্পর্ক নয়;প্রেম সর্বত্র সকল প্রাণীতে বিভাজিত। মাতাপিতা ও সন্তানের প্রেম, পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের প্রেম, স্বগোত্রীয় মানুষের পারস্পরিক প্রেম, দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, সর্বোপরি স্রস্টার সাথে সৃষ্টির প্রেম। কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্’র ‘ছেঁড়া পঙক্তি’এবং গীতিকাব্য ‘মনের মেঘে পাখনা মেলে’গ্রন্থদুটির প্রধান কাব্যবিষয়ও হচ্ছে প্রেম।
বই দুটির প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে প্রেম। অধিকাংশ কবিতা নারীপ্রেমের হলেও দেশ প্রেমের কবিতাও স্থান পেয়েছে। ’ছেঁড়া পঙক্তি’কাব্যের ভাষার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় গ্রন্থটিতে ৮-৫, ৮-৬ স্বরবৃত্ত মাত্রায় নিজস্ব আঙ্গিকের ৩৯৬ টি অনুকবিতায় সাজানো হয়েছে এই কাব্যকানন। প্রতিটি অণুকবিতার দ্বিতীয় এবং চতুর্থ পঙক্তিতে মাত্রার সামঞ্জস্য রেখে অন্তমিল দেওয়া হয়েছে। ’ছেঁড়া পঙক্তি’র কয়েকটি চুম্বক কবিতা এখানে তুলে ধরছি ঃ
“দেশটা রেখো বুকের মাঝে/ কষ্ট যতোই পাও/ লাল সবুজের এই পতাকার/ গাও গুণগান গাও”।
“তুই যে আমার নাড়ির মাটি/ কাব্যকুসুম প্রাণ/ তোর মাটিতে জীবন পুঁতে/ ছড়িয়ে দেবো ঘ্রাণ।” (পৃষ্ঠা-৭)
“ডাকপিওনের ডাক শুনেছি/ আসলো কি তার চিঠি/ প্রেমসোহাগি খামের ভেতর/ হাসবে মিটিমিটি।” (-১১)
“তোমার প্রেমের অপেক্ষাতে/ মন হয়েছে ধ্যানী/ প্রেম পরশে চাই গো সখী/ তোমার হৃদয়খানি।” (পৃষ্ঠা-১২
“চোখের ভেতর তোমায় নিয়ে/ উড়তে পারি ঘুমে/ ঠোঁটের ওমে বালিশ নিয়ে/ স্বপ্ন জাগা চুমে।”
“পথ তুমি যাও বাড়ির কাছে/ একটু তারে কও/ ফেরার পথে দাঁড়িয়ে আছি/ একটু সাথে লও।” (পৃষ্ঠা-১৪)
“একশ চারের জ্বরের ঘোরে/ ডাকছি তোমার নাম/ জ্বরের ঘোরে হাতটি তোমার/ অন্য মালিশ বাম।” (পৃষ্ঠা-১৫)
“তুমি আমার মেঘ আকাশে/ একটি তারার বাতি/ মেঘ ঝরঝর বৃষ্টি দিনে/ নির্ভরতার ছাতি।” (পৃষ্ঠা-১৮)
“বুকের ওপর দিলে জমা/ তোমার রঙিন ঠোঁট/ পড়শি পাড়া দেখবে বলে/ আড়াল করি কোট।” (পৃষ্ঠা-২১)
“তোমার বুকে ডাক পাঠালাম/ বললে তুমি আসছো/ আছড়ে পড়ে বুকের ওপর/ ঠোঁট টি টিপে হাসছো।” (পৃষ্ঠা-২৯)
“রাত্রি এলে বিড়াল হাঁটার/ দুইটি ভীরুর ছাপে/ ঘরের কোণের চৌপায়া টা/ ইঞ্চি করে মাপে” (পৃষ্ঠা-৬৮)
‘মনের মেঘে পাখনা মেলে’একটি গীতিকাব্য। ৩৬টি গীতিকবিতার সমাহার এই গ্রন্থটির মাধ্যমে কবি আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ লিমেরিক, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতার পরেও গান রচনায় শক্তিমত্তার পরিচয় দিলেন।
গানের ব্যাকরণ মেনে তিনি ছন্দের গুঞ্জনে ও ভাবের স্পন্দনে সুরের আরক তৈরি করেছেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। ‘স্থায়ী’ এবং ‘অন্তরা’র সফল ও সার্থক প্রয়োগ প্রমাণ করে কবি মিছবাহ্ কেবল একজন বহুদাচারি লেখক ই নন;একজন কৌশলী গীতিকবিও বটে।
মানবজীবন ও সমাজের নানাবিধ উপলব্ধি ও উপকরণ ফুটে উঠেছে তাঁর গীতিকাবিতায়। কয়েকটি গানের চমৎকার কলি:
“কাছে এসে জুড়ে বসে ছুড়ে দিলে গল্প/ তুমি কি গো বুঝে এলে ওগো ছোটোগল্প।” (পৃষ্ঠা-১১)
“একলা বেলা একলা কাটে একলা হাঁটি দূর/ বুকের মাঝে আটকে আছে মরাল সমুদ্দুর।” (পৃষ্ঠা-১২)
“তুমি আমার দিলের খনি/ বুকে বাজাও প্রেমের ধ্বনি/ নদীর বুকে পাখনা মেলে/ গুঁজে খোঁপায় ফুল-
যাবো নদীর কূল, কন্যা যাবো নদীর কূল।” (পৃষ্ঠা-১৩)
“মনে আমার আসে জোয়ার তোমায় কাছে পেলে/ তুমি বিহীন মন ভরে না দূরে কোথাও গেলে।” (পৃষ্ঠা-১৭)
“আকাশ খুলে বৃষ্টি এলে জানলা খুলে রাখি/ তোমার লাগি মনগগনে করছে মাখামাখি। ” (পৃষ্ঠা -২২)
“কী দেখাবি ময়নারে তুই/ কী দেখাবি খেল।/ কবরখানায় কিনবিরে তুই/ আন্ধার একটা জেল।” (পৃষ্ঠা -২৩)
“প্রেমে অভাব নাইরে বন্ধু/ অভাব শুধু টাকা/ প্রেম ছাড়ারে প্রেমের থলি/ সবই লাগে ফাঁকা।” (পৃষ্ঠা-৩১)
“মনের ঘরে আগুন দিয়া/ কোথায় তুমি লুকাও গিয়া/ ওগো প্রাণের প্রিয়া।/ াথায় রাখি ধরে তোমায় ওগো প্রাণের টিয়া।” (পৃষ্ঠা -৩২)
আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্ একজন জীবনঘনিষ্ঠ প্রেমের কবি। তাঁর কবিতায় মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, জীবনের জটিল সমীকরণ ও রসায়ন সমাজের সংগতি-অসংগতির পাশাপাশি দেশপ্রেম ও নারীপ্রেম উপজীব্য হয়েছে। ভাব, ভাষা ও ছন্দে তাঁর কবিতা একটি বিশেষ উচ্চতায় আরোহণ করেছে।
‘একবাক্স দীর্ঘশ্বাস ‘ছেঁড়া পঙক্তি’ গ্রন্থ দুটি প্রকাশ করেছে বাসিয়া এবং ‘মনের মেঘে পাখনা মেলে’প্রকাশ করেছে নাগরী। গ্রন্থ তিনটির প্রচ্ছদ, ছাপা ও বাঁধাই বেশ আকর্ষণীয় ও চমৎকার। দামও পকেটের নাগালে। বই তিনটির ব্যাপক পাঠ, প্রচার ও প্রসার কামনা করছি।
কবি আনেয়ার হোসেন মিছবাহ্’র সাহিত্যসাধনা আরও গতিশীল ও ঋদ্ধ হোক সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।।