সংবাদ সম্মেলন: শত কোটি” টাকারও বেশি লুট
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ নভেম্বর ২০২২, ১০:১৪ মিনিটসিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে বিগত দিনে একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ ও জালিয়াতি সিন্ডিকেট “শত কোটি” টাকারও বেশি লুটে নিয়েছে।এই চক্রের অন্যতম হোতা ছিলেন সাবেক সহকারী সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা মহিতোষ চন্দ্র দাস।তিনি সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব,বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক ও রম্য লেখক আতাউর রহমানের অনেক মূল্যবান ভূমি জালিয়াতির মাধ্যমে আরেকজনকে লিখে দিয়েছেন।সিলেট সদর উপজেলার কুমারগাও এবং কালাগুল মৌজায় দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড করে দিয়েছেন।সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে এদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবী জানানো হয়েছে।গতকাল সোমবার দুপুরে সিলেট প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার রফিপুরের মালিক জোনেদ আহমদ এই দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি আতাউর রহমানের ভূমির বর্ননা দিয়ে বলেন,গোলাপগঞ্জ উপজেলার নগর গ্রামের মৃত আবুল খায়রাতের পুত্র আতাউর রহমানকে ১৯৯৪ সালের ২১ মার্চ শাহজালাল উপশহরের জে ব্লকের ৪ নং রোডে (৫ কাটা বা সাড়ে ৮ শতক) ২৯ নম্বর প্লটটি ৯৯ বছরের জন্যে ইজারা দেয়া হয়।চাকরির সুবাদে অন্যত্র কর্মরত থাকায় মাঠ পর্যায়ে জরিপ কার্যক্রম চলাকালে তিনি প্লটটি নিজের নামে রেকর্ড করাতে পারেননি।মাঠ জরিপে এস.এ ১২৫ ও ১২৬ নং দাগ হতে সৃষ্ট আর.এস ৪১২২ নং দাগে ৮ শতক ২৬ পয়েন্ট ভূমি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও জনৈক তারা মিয়া গংদের নামে রেকর্ড হয়ে যায়।পরবর্তীতে তিনি বাদী হয়ে উক্ত ভূমি তার নামে রেকর্ড সংশোধনের জন্যে ১১ নং আর.এস ডিপি খতিয়ানের রেকর্ডিয় মালিক গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ৩৬০ নং আপত্তি এবং ১৭৪৮ নং আর.এস খতিয়ানের রেকর্ডিয় মালিক তারা মিয়া গংদের বিরুদ্ধে ৩৫৯ নং আপত্তি মামলা দায়ের করেন।২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আপত্তি অফিসার মামলা দুটি খারিজ করে দেন।এরপর তিনি ৩১ বিধি অনুযায়ী খারিজ হওয়া দুটি মামলার বিরুদ্ধে আপীল করেন।আপীল মামলা নম্বর-১৩১৬৭/২০১৬।সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার ও আপীল অফিসার মহিতোষ চন্দ্র দাস ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর এই আপীল মামলার শুনানি করেন।শুনানী শেষে ওই দিনই রায় ঘোষণা করে আতাউর রহমানের নামে ওই ভূমির রেকর্ড দিয়ে মহিতোষ চন্দ্র দাস নিজে স্বাক্ষর করে তাৎক্ষণিকভাবে রায় অনুযায়ী ৪১০৩ নং খতিয়ানে আতাউর রহমানের নামে রেকর্ড করে দিয়ে পর্চাও দিয়ে দেন।তার মৃত্যুর পরে মুদ্রিত খতিয়ানেএই ভূমির মালিক হিসেবে জকিগঞ্জ উপজেলার ফুলতলা গ্রামের হাজী আব্দুল বারির পুত্র আব্দুস শহীদ চৌধুরীর নাম রয়েছে।এরপর ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের তদন্তে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।তদন্ত শেষে সিলেটের জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার গত ২৭ সেপ্টেম্বর ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নিকট প্রতিবেদন প্রেরণ করেন।প্রতিবেদনে জালিয়াতির মাধ্যমে অতিরিক্ত সচিব আতাউর রহমানের ভূমি রায় পরিবর্তন করে অন্যের নামে দেয়ার বর্ননাও দেয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মালিক জোনেদ আহমদ আরও বলেন,মহিতোষ চন্দ্র দাস গোলাপগঞ্জ উপজেলার ২ নং হাতিমনগর উত্তর মৌজার সরকারি ১নং খাস খতিয়ানের ২৭ একর জমি ভূয়া কবুলিয়াতের মাধ্যমে ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড করে দেন।এই জমি উদ্ধারের জন্য ইতোমধ্যে গোলাপগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিৎ চৌধুরী সিলেটের জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের নিকট লিখিত আবেদন করেছেন।সিলেট সদর উপজেলার মিউনিসিপ্যাল মৌজা,বাগবাড়ি মৌজা,বহর মৌজা,কুমারগাও মৌজা, সাদীপুর ১ম খন্ড মৌজা,গোলাপগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলায় এভাবে জালজালিয়াতির মাধ্যমে একজনের জমি আরেকজনকে রেকর্ড, সরকারি খাস জমি বেহাত করেছেন।কোনো কাগজপত্র কিংবা নুন্যতম দখল ছাড়াই জগন্নাথপুরে একাধিক এলাকায় জমি রেকর্ড করে দেন।তার পেশকার প্রসেস সার্ভার আব্দুল কাদিরও কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে।শুধু মহিতোষ দাস নয় সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার ধ্রুব রঞ্জন দেব বিশ্বাস সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের সিলেট নগরীর আখালিয়ায় সড়ক বিভাগের অধিগ্রহণকৃত জমি ব্যক্তি মালিকানায় দিতে প্রতিবেদন দেন।এরকম আরও অনেক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে যা সঠিক তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে।এএসও মহিতোষ চন্দ্র দাস ও আব্দুল হাই আজাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে চিঠি দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে বিভাগীয় মামলাও চলমান আছে।আরেক এএসও জিতেন্দ্র চন্দ্র দাসের পেনশন আটকে দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।তার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে।এএসও ধ্রুব রঞ্জন দেব বিশ্বাস সিলেট নগরীর সেনপাড়ার এস.পি টাওয়ারে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট কিনেছেন।কিন্তু কোনো ধরনের মামলা বা আপীল ছাড়াই ফ্ল্যাটটি নিজের ও স্ত্রীর নামে অবৈধভাবে রেকর্ড করে নিয়েছেন।তার খতিয়ান নং (ডিপি)- ২৬০৭, মৌজা- কসবে সিলেট রায়নগর।এএসও ধ্রুব রঞ্জন দেব বিশ্বাস ও অফিস সহকারী নেপাল চাকমার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত চলছে।এছাড়াও প্রসেস সার্ভার সুজিত কুমার দে’কে শাস্তি স্বরুপ বাধ্যতামুলক অবসর দেয়া হয়েছে।সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার যথাক্রমে মো. গিয়াস উদ্দিন,মহিতোষ চন্দ্র দাস,ধ্রুব রঞ্জন দেব বিশ্বাস ও রফিক মিয়াসহ সেটেলমেন্টের ৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সিলেটের আদালতে স্পেশাল মামলা হয়েছে।যা বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে।
সংবাদ সম্মেলনে মালিক জোনেদ আহমদ আরও বলেন,দুর্নীতিবাজ চক্রকে রক্ষা করতে জনৈক ব্যক্তি ইতোমধ্যে নানা অসত্য ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন।ওই ব্যক্তি সিলেট সদর উপজেলার ছালিয়া মৌজায় সরকারি ১ নং খতিয়ানের খাস জমি রেকর্ড করে নেন। সদর উপজেলার উত্তরকাছ ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ২০২০ সালে সিলেট সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি)কে ওই খাস জমির রেকর্ড বাতিল করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহণের জন্য পত্র দেন।এর প্রেক্ষিতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সিলেটের জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের নিকট ওই জমি সরকারের নামে রেকর্ড করতে পত্র দেন।এরপর এবিষয়ে এএসও কারীগরী উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির তদন্ত করেন।তদন্তে খাস জমি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডের বিষয়টি উঠে আসে।এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে ওই ব্যক্তি ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নিকট হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন।জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের তদন্তে তার করা অভিযোগ প্রমানিত হয়নি।বিশম্ভরপুর উপজেলার জনৈক সুলেমান ফারুকের কোনো আপীল মামলা সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে কখনো ছিলনা।কিন্তু তিনি লিখিত অভিযোগে দাবী করেন,যে আপীল মামলার জন্য সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার হুমায়ুন কবির তার কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়েছেন।অভিযোগে তার নিজ এলাকার আব্দুল মোমিন নামের আরেক ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয়।বিষয়টির অফিসিয়ালি তদন্তে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।তদন্তে সত্যতা না পাওয়ার পর ওই সুলেমান ফারুক নতুন করে সুনামগঞ্জ আদালতে একটি স্পেশাল মামলা দায়ের করেন।আগের অভিযোগে শুধু এএসও হুমায়ূন কবিরকে অভিযুক্ত করা হলেও এবার এই মামলায় হুমায়ূন কবিরের সাথে ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী আব্দুল মান্নানকেও আসামি করা হয়েছে।যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিস দীর্ঘদিন একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের নিকট “বন্দী” ছিল।এরা তাদের ইচ্ছে মাফিক টাকার বিনিময়ে রেকর্ড দিয়েছে।এদের প্রায় সকলেই এখন অবসরে।একজন ছাড়া বাকী কেউ অবসরের পেনশনের একটি টাকাও পায়নি। তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন।ওই চক্র “শত কোটি” টাকারও বেশি লুটে নিয়েছে।এদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে তিনি প্রধানমন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রী,জনপ্রশাসন মন্ত্রী,ভূমি সচিব,জনপ্রশাসন সচিব,দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক,সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।