অধ্যাপক শেখ আব্দুর রশিদ কুয়াঁশাচ্ছন্ন শীতের ভোর, রোদ উঠতে শুরু করেছে কেবল। গ্রামের গাছ-গাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের আলোকছটা ভৃ-পৃষ্ঠে, পুকুরের স্বচ্ছ জলে এসে পড়েছে। কয়েকজন দুরন্ত কিশোর পুকুরের পানিতে নেমেছে সাঁতার কাটতে। সাঁতার কাটতে কাটতে তারা একদম মাঝ পুকুরে চলে গেছে। পুকুরের পানি হিম ঠান্ডা এর মধ্যে একটি কিশোর হঠাৎ অনুভব করলো হাত পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে ঠিকভাবে সে আর সাতরাতে পারছেনা, ধীরে ধীরে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে অন্যদের বুঝানোর চেষ্টা করলেও কে শোনে কার কথা? কেউতো টেরই পাচ্ছেনা যে তাদের একজন বন্ধু পানিতে ডুবতে বসেছে। উপরোক্ত ঘটনার পিছনে একটা বৈজ্ঞানিক কারণ আছে, তবে এখন আমরা অন্যদিকে নজর দিই।
গত কয়েক বছর থেকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে পুরো বিশ্বব্যাপি আলোচিত হচ্ছে। এনিয়ে নানা উদ্যোগও গ্রহন করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে কী এসব উদ্যোগের কোন ফল আমরা দেখেছি ? প্রাণি বা জীব জগতের অস্তিত্ব নির্ভর করছে তার পরিবেশের উপর। মাটি, পানি, বায়ু, উদ্ভিদ ও প্রাণি এসব জড় ও জীব উপাদানকে বিচ্ছিন্ন সত্তা মনে হলেও ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে যে বাস্তব অবস্থা সেটাই হচ্ছে পরিবেশ। আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদে যে প্রভাব জড় ও জীব উপাদানের উপর পড়ে সেটাকে বলে জলবায়ুর পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ যে কয়েকটি দেশ তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। এই জলবায়ু পরিবর্তনে ভারসাম্যহীন বা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মাটি, পানি ও বায়ুমন্ডল। এসবকিছুর সমন্বিত ফলাফল ভোগ করছে মানুষ । ভবিষ্যতে আরো কঠিন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে মানুষকে। কল্পনায় একবার ভাবুন তো? বাতাসে অক্সিজেন সংকটের কারণে অক্সিজেন সিলিন্ডার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আর মুখে লাগানো রয়েছে মাস্ক! কোনভাবে মাস্ক খুলে গেলেই অক্সিজেনের অভাবে মারা পড়ছে মানুষ কিংবা এরকম একটা সমূহ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে মানুষ।
এক অনুষ্ঠানে একজন বক্তা বলেছিলেন তার আনন্দ আর খুশির কারণ। কারণ কী ? বিজ্ঞানীরা প্লাস্টিকের গাছ আবিষ্কার করেছেন যে গাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেবে এবং বাতাসে অক্সিজেন ছেড়ে দেবে। এই গাছ কারখানা বানিয়ে তারা কি আপনার দেশের জন্য ফ্রি করে দেবে ? সম্মানিত বক্তা! আমরা আসলে ব্যবসায়ীদের দায়ী করি মানুষকে শোষন করার জন্য। কিন্তু সেই সব আহাম্মকদের দায়ী করি না যারা নিজে যেয়ে ধরা দেয় শোষিত হওয়ার জন্য। তাছাড়া পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করার জন্য বড় ভ‚মিকা রাখছে প্লাস্টিক। ধরলাম প্লাস্টিক গাছের গ্যারান্টি ১৫ বছরের। পুরো ১৫ বছর তো ঠিকভাবে চলবে তার নিশ্চয়তাও নেই। তার চেয়ে বরং যদি গাছের চারা লাগান ১৫ বছর পরে তা কাঠের চাহিদা মেটাবে এবং আরো যেটা হবে এই গাছের কাঠ অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করবে, এছাড়া গাছতো প্রকৃতির একটা অংশ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক থাকলো এবং অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের ভারসাম্যও ঠিক থাকলো। মানুষ বাস করছে পৃথিবী পৃষ্ঠে পৃথিবীর চারপাশে গাছ-পালা পশু-পাখি এগুলো দৃশ্যমান। কিন্তু বায়ু সমুদ্রে যে মানুষ ডুবে আছে ?
উপরে পাশে তলায় সর্বত্র বিরাজ করছে বায়ু। স্বচ্ছ বর্নহীন, গন্ধহীন গ্যাসীয় পদার্থ বলে বায়ু বা বাতাসের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। এই বায়ু অনেকগুলো গ্যাসের মিশ্রন। তাদের মধ্যে প্রধান দুটি হল নাইট্রোজেন ৭৭%, অক্সিজেন ২১% এবং অন্যান্য ২% যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড, আরগন, হিলিয়াম, নিওন, ক্রিপ্টন, জিনন, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি। এদের মধ্যে কার্বন মনোক্সাইড সবচেয়ে বিষাক্ত গ্যাসগুলোর একটি। নিশ্বাস নেবার সময় আমরা উপরোক্ত সবগুলো গ্যাসই বুকের মধ্যে টেনে নেই কিন্তু ব্যবহার করি শুধু অক্সিজেন। এই অক্সিজেনই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। অক্সিজেন যদি কমে যায় তাহলে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। বায়ুমন্ডলে উপরোক্ত উপাদানগুলোর পরিমানের অনুপাত সামঞ্জস্যপূর্ন অবস্থায় থাকে। এর যখন হেরফের হয় তখনই সমস্যার সৃষ্টি হয়।
পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এ বিষয়টি সবাইকে শংঙ্কিত করে তুলছে। এই উত্তপ্ত হওয়ার পেছনে শুধু কার্বন-ডাই-অক্সাইড নয়। বাতাসে ধুলিকণার পরিমান যত বাড়বে ততই পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। একটা বিষয় আগেই বলে নেয়া দরকার যে বায়ু দূষন ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, বক্ষব্যাধি সহ আরো কিছু বিষয় ঘটে তা হল রক্তে অক্সিজেন যোগানে বিপত্তি! শরীরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিলে শরীরের স্বাভাবিক প্রবণতা হয় ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে এবং রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে ক্ষতিপূরনের চেষ্টা। রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে গিয়ে হার্টের উপর চাপ পড়ে। এভাবে বায়ু দূষণ পরিণামে পরোক্ষভাবে হার্টের অসুখের কারণ ঘটায়। বায়ুমন্ডলে বিষাক্ত দুটি গ্যাস অনুপ্রবেশ করছে এর একটি কার্বন মনোক্সাইড অন্যটি হাইড্রোজন সালফাইড। কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসটি অতিমাত্রায় বিষাক্ত। এর প্রভাবে রক্তে হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন পরিবহন ক্ষমতা হ্রাস করে দেয় এবং মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বায়ু দূষণ বাড়ছে আর সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস বোতলে ভরে বিক্রির ধান্ধা শুরু করেছেন কিছু চতুর ব্যবসায়ী তা শুনা যাচ্ছে। নিজের সাফল্যে চমৎকৃত ক্যানাডার এডমন্টনের ভাইটিলিটি এয়ারের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোজেস লামা টেলিভিশন চ্যানেল বিসিবির এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন, পুরোটাই শুরু হয়েছিল রসিকতার অংশ হিসেবে। কিন্তু প্রথম উৎপাদনের ১০০ বোতল যখন চার দিনেই শেষ হয়ে যায়, তখন তিনি বিষয়টাকে পেশাগত রূপ দেয়া শুরু করেন। ভাইটিলিটি এয়ার শুধু চীন না , ভারত, কোরীয়া এবং ভিয়েতনামেও ব্যবসা চালাচ্ছে। আসুন নিজের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে প্রভুর কাছে পানাহ চাই, আমার এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন অক্সিজেন কিনে জীবনধারণ করতে না হয়, সেজন্য সময় থাকতে উদ্যোগী হতে হবে আমাদেরকেই।
বোতলে মিনারেল ওয়াটার প্রথম দিকে যখন বাজারে আসে কেউ কেউ খেতেন কেউবা খেতেন না। এখন বিয়ের সেন্টার থেকে শুরু করে সকল হোটেল সবখানে মিনারেল পানি। কিছু কিছু হোটেল রয়েছে বোতলের মিনারেল পানি ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থাই নেই। অথচ মিনারেল ওয়াটার যে পান করে সে যেমন বাঁচে ৬৫/৭০ বছর আবার যে জীবনে মিনারেল পানি দেখেনি বা পান করেনি তার আয়ুও ৬৫/৭০ বছর! সুতরাং সাবধান!! বোতলের বাতাস ব্যবসা সহজে সবার কাছে গ্রহনযোগ্যতা পাবে কারন ব্যবসায়ীরা কত কিছু বুঝাবে তার ইয়ত্তা নাই। বিশুদ্ধ বাতাস নেন না হয় আপনার হার্ট ফুসফুস সব যাবে! সুতরাং সিদ্ধান্ত ঠিক করতে হবে আপনাকে ক্রয়কৃত বোতলের অক্সিজেন নিয়ে বাঁচবেন? না খোলা পৃথিবীর ফ্রি অক্সিজেন নিয়ে বাঁচতে চান। যদি সিদ্ধান্ত দ্বিতীয়টি হয় তাহলে আপনারও কিছু দ্বায়িত্ব আছে।
তা হচ্ছেঃ প্রথমত বায়ু দূষণের কারণগুলো সনাক্ত করা, যেমনঃ যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোয়া, জ্বালানির দহন, বনভূমি উজাড় প্রভৃতি কারণে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধি পায়। ইটভাটা পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে আম, তেঁতুল, সুন্দরী, মেহগনি, শিরিষ, খেজুর সহ বিভিন্ন ধরনের গাছপালা। এসব ইটভাটার চিমনি ১২০ ফুটের কম উচ্চতায় থাকার কারনে বিপন্ন হচ্ছে স্বাস্থ্য। ত্রæটিপূর্ণ যানবাহন, বেবিটেক্সি, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি এবং বিক্ষিপ্তভাবে স্থাপিত কাগজ, পাট ও টেক্সটাইল কারখানা থেকে অবিরাম পরিবেশ বিনষ্টকারী কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত রাসায়নিক বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে এসব উৎস থেকে সৃষ্ট মিথেন, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণি দেহের ভীষণ ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ১৯/০২/২০১৯ তারিখে ভোরের কাগজ বায়ুদূষণ; বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে ঢাকা পত্রিকায় একটা গবেষণা সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয় যে, প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লক্ষ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে বায়ু দূষণ জনিত কারনে।
বায়ু দূষণকারী গ্যাস নির্গমণবন্ধ করা সহ গাছ রোপনে বিশেষভাবে উদ্যেগ গ্রহন করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হওয়া স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং বাস্তব কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। বাতাসে অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিক রাখতে হলে গাছ লাগাতে হবে সর্বত্র। পাহাড়, বনাঞ্চল কমছে সাথে সাথে কমছে গাছ এবং গাছ কমছে মানে হচ্ছে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। এখন রাষ্ট্র যদি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম বেঁধে দেয় যেমনঃ সারা দেশে যত পাকা বা কাঁচা রাস্তা রয়েছে সেই রাস্তাগুলোর মাঝখানে প্রতি ৬ বা ৮ ফুট অন্তর গাছ থাকতে হবে, প্রতিটি মসজিদ, বাসা বা বাড়ির সামনে অন্তত ৪ টি গাছ থাকতে হবে, গোরস্থান, শশ্মান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা নিয়ম করে দিতে হবে কত পরিমাণ জায়গায় গাছ থাকতে হবে। আমরা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি ভারতের বহু রাজ্য পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। সময়মতো বৃষ্টি হচ্ছে না মূল কারণ গাছপালার শূন্যতা। সময় থাকতে সাধু সাবধান! দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটা দিঘী থাকবে (দিঘীর মাপ সরকার থেকে নির্ধারন করে দেয়া হবে) এ বিষয় নিয়ে আমরা পরে লিখব। এসব দিঘীর চারপাশে থাকবে গাছ। এই গাছগুলো থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের চাহিদা মিটে যাবে আশা করা যায়। বরং পৃথিবীর কিছু মানুষ যদি সচেতন না হয় তাদের যদি অক্সিজেন ক্রয় করে চলতে হয় তাহলে সেই অক্সিজেন সাপ্লাইয়ার দেশ যেন আমরা হতে পারি যা দিয়ে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ উপার্জন সম্ভব হবে। যদিও আমরা চাই না সেরকম অবস্থা পৃথিবীর কোথাও হউক। আমরা চাই সবুজ বাংলাদেশ, সবুজ পৃথিবী।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) লতিফা-শফি চৌধুরী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট।
সম্পাদকঃ আব্দুল বাতিন ফয়সল, সহ-সম্পাদকঃ আব্দুল মুহিত দিদার
অফিসঃ সিলেট সিটি সেন্টার, রুম- ৯০৬ (এ), ৯ম তলা,জিন্দাবাজার, সিলেট।
মোবাইলঃ ০১৭১১৩৩৪৬৪১, ০১৭৩০১২২০৫১
email : syfdianews@gmail.com