থ্যাকারে টিলায় নাইটকুইন চাষ
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:৫৭ মিনিট
সেলিম আউয়াল :
নাইটকুইন ফুল ফোটার আগে কলিটা একটু ফোলা ফোলা থাকে। সেই ফোলা ফোলা কলি থেকে ফুলের ফুটে যাওয়া পর্যন্ত কয়েক ঘন্টার ব্যাপারটি মাত্র মিনিট খানেক সময়ে দেখলাম। বিদেশি কোন ভিডিও-তে নয়, আমাদের কাছের একজন ঔপন্যাসিক আলেয়া রহমানের বাসায় নাইটকুইন ফুল ফুটেছে, সেই ফুল ফোটার ভিডিওচিত্র। বেশ অবাক কা-ই। জিগ্যেস করলাম এটা কি করে সম্ভব হলো! সে একটি দীর্ঘ কাহিনীÑতার বাসার নাইট কুইন ফুল ফোটার লক্ষণ হিসেবে ফুলের কলি ফুলতেই তার ছেলে অনিক ফুল বরাবরে একটি মোবাইল ক্যামেরা ফিট করে দেয়। সেই কলি থেকে ফুল ফোটা, আবার পাঁপড়ি চুপসে আসা পর্যন্ত কয়েক ঘন্টার পুরো ব্যাপারটি সেই ক্যামেরায় রেকর্ড হয়। তারপর সেই রেকর্ডটি একটু স্পিডে চালিয়ে কয়েক ঘন্টার ব্যাপারটি মিনিট খানেকে নিয়ে এসেছে এবং চোখের সামনেই একটি ফুল ফোটে। আলেয়া রহমান বললেন, একটিমাত্র ফুল ফুটেছে, কিন্তু ফুল ফোটা নিয়ে সে কী উৎসাহ। নাতি ইহানকে নিয়ে তার মেয়ে ইভা আসে ফুল ফোটা দেখতে, মা-মেয়ে-পুত্র সারা রাত জেগে ফুল ফোটার দৃশ্য দেখেন। এটা এই আগস্টের (২০২২) ঘটনা। যদিও নাইনকুইন এখন অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে।
আমাদের বাসায়ও একটি রাতে নাইটকুইন ফুটেছিলো, বিশ-পঁিচশ বছর আগে। আম্মাকে নিয়ে আমরা ভাইবোন সারা রাত জেগে ফুলের ফোটা দেখেছি। তখন মোবাইল ক্যামেরা ছিলো না। ফিল্মে ছবি তোলা হতো, খুব হিসেব করে ফিল্ম বাঁচিয়ে ছবি তুললেও পুরো একটি ফিল্ম শেষ হয়ে গিয়েছিলো। রাত জেগে ফুল ফোটা দেখবো বলে রাতে আম্মা আখ্নি রেঁধেছিলেন।
নাইটকুইন নিয়ে মানুষের ছিলো কতো কৌতুহল, অনুভব করা যাবে সিলেটের ডাকে বের হওয়া আমরা একটি প্রতিবেদন পড়লে। সেই তিরিশ বছর আগে সিলেটের ডাক পত্রিকায় আমি নাইটকুইন বিশাল একটি প্রতিবেদন করেছিলাম। প্রতিবেদনটি খুব গুরুত্ব দিয়ে সিলেটের ডাক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। সেটি ছিলো থ্যাকারে টিলায় এমসি কলেজের প্রিন্সিপালের বাংলোয় নাইটকুইন চাষ এবং ফুল ফোটার গল্প। প্রিন্সিপালের বাংলোটি আজো থ্যাকারে টিলা নামে পরিচিত। একসময় উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকারে নামে একজন ইংরেজ প্রশাসক এখানে বাংলো বানিয়ে থাকতেন।
আজ অনেকের ঘরে নাইটকুইন আছে। আগে যেখানে একটি দুটো ফুল ফুটলে তা ঘটনা হিসেবে গণ্য হতো, কিন্তু আজ প্রায়ই নানাজনের বাসায় নাইটকুইন ফুটে আর দশটি ফুল ফোটার মতো একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে। একবার তো পত্রিকায় একজন ছবি পাঠিয়েছিলেন, তার গাছে বিশটি না তিরিশটি ফুল ফুটেছে। বিষয়টি তখন এতো কমন হয়ে গিয়েছিলো, ছবিটি আর ছাপানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু থ্যাকারে টিলায় নাইটকুইন ফোটার খবর পেয়ে আমি বন্ধু ইকবাল বাহার সোহেলকে নিয়ে প্রায় রাত কাটিয়েছিলাম প্রিন্সিপাল বাংলোয় তার পরিবারের সদস্যরাও রাত জেগে উপভোগ করেছেন নাইটকুইন ফোটা’র বিরল মুহূর্তগুলো।
সিলেটের ডাকে (০৩.০৭.১৯৯২) ‘নাইটকুইন’ এবং একজন বৃক্ষ প্রেমিক শিক্ষাবিদ’ শিরোনামে আমার লেখা রিপোর্টটি পুরো তুলে দিলাম। অনুভব করা যাবে তিরিশ বছর আগে নাইটকুইন ফুল নিয়ে আমাদের ভাবনা ক্যামন ছিলো। একই সাথে এক সময়ের সিলেটের সবুজ একটি ছবি।
‘‘নাইটকুইন-বিরল প্রজাতির এ গাছ নিয়ে অনেক কথা। শোনা যায় দশ-বারো বছরে নাকি একবার ফোটে। মাত্র ক’ঘন্টার জন্য ফোটেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। খুব কমই দেখা যায় এ ফুল। তাই একে নিয়ে পুষ্পপ্রেমীকদের নানা জল্পনা-কল্পনা।
পয়লা জুলাই বিরানব্বই-র রাতে বিরল এই ফুলটি ফুটেছিল সিলেট এম.সি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর হাসান ওয়ায়েজের বাসায়। দু’টো গাছের একটিতে ৭টি এবং অপরটিতে ১টি ফুল। তাঁর জীবনে ‘নাইট কুইন’ অনেকবার ঘটেছে। বছর দুয়েক তিনি টবে ‘নাইট কুইন’ লাগিয়েছেন। গাছ লাগাবার এক বছর পর ফুল ফুটছে। এ পর্যন্ত ৩/৪ বার ফুটেছে-প্রতি বারই একসাথে ৭/৮টি ফুল।
গাছের পাতা থেকে ফুল বেরোয়। গাছটা দেখতে ‘পাথর কুচি পাতার’ মতো এবং ফুলগুলো অনেকটা শাপলা ফুলের মতো। তবে সবগুলো পাঁপড়ি শাদা-পুরু ও শাপলা ফুলের চেয়ে সাইজে বড়ো। পাঁপড়ির মধ্যিখানে বড়ো ধরনের একটা পরাগদন্ড এবং খুব কাছ থেকে শুঁকলে এক ধরনের বুনো ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়।
সেদিন সন্ধ্যে সাড়ে ৭টার দিকে ফুলটি ফুটতে শুরু করে এবং রাত ন’টার দিকে মোটামুটি ফুটে যায়। তবে রাত বারোটার দিকে ফুলটি পূর্ণাঙ্গরূপ পায়। আবার ভোর পাঁচটার দিকে পাঁপড়িগুলো বুজে আসে এবং ফুলগুলো ভারী হয়ে নুয়ে পড়ে। ফুল ফোটার ৭/৮ ঘন্টা আগে থেকেই লক্ষণ বুঝা যায়। কারণ তখন কলিগুলো ফুলতে শুরু করে।
অধ্যক্ষ হাসান ওয়ায়েজ একজন বৃক্ষপ্রেমিক। ’৮৯-এর ১৭ জানুয়ারি সিলেট এম. সি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। এর আগে ময়মনসিংহ-এর আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
সিলেটে আসার পর এম.সি. কলেজের বিশাল ক্যাম্পাসে গাছ লাগাতে শুরু করেন। আনন্দমোহন কলেজেও প্রচুর গাছ লাগিয়েছেন। সেখানের ক্যাম্পাসটি ছিলো ছোট, তবে কলেজে একটি মাত্র গেট থাকায় গাছ সংরক্ষণে সুবিধে ছিলো। এ পর্যন্ত সিলেট এম.সি কলেজে শ’তিনেক গাছ লাগিয়েছেন এবং সবগুলো গাছই বেঁচে আছে। এখন প্রতি শুক্রবারই তিনি কিছু কিছু গাছ লাগান।
তিনি ক্রিসমাস ট্রি, পাইনসহ অনেক মূল্যবান গাছ লাগিয়েছেন। কলেজে একটি বোটানিকেল গার্ডেন করেছেন।
বললেন, গাছ লাগাতে অনেক সমস্যা। গরু-ছাগলের হাত থেকে তা’ সংরক্ষণ করা খুবই মুশকিল। বৃক্ষের শত্রু নি¤œতম প্রাণী থেকে উচ্চতর প্রাণী। অনেক শিক্ষিত লোকেই বদঅভ্যাসবশতঃ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাতা ছেড়ে। ঝড়ে গাছ নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রয়োজনে অধিক হারে গাছ লাগাতে হবে। শুধু গাছ লাগানোর মধ্যে কৃতিত্ব নেই- গাছকে সংরক্ষণ করে ফুল ফলে পল্লবিত করাটাই আসল ব্যাপার।
প্রফেসর হাসান ওয়ায়েজ জানালেন, গাছ সংরক্ষণ করতে খরচ অনেক বেশি। কিছুদিন পরপর বাঁশের খাঁচা বদলাতে হয়। ইট দিয়ে স্থায়ী খাঁচা তৈরি করতে পারলে অনেক ভালো হতো।
ক’দিন আগে স্যার জানিয়েছিলেন, নাইট কুইন ফোটার সম্ভাবনার কথা। নাইট কুইন ফোটার খবর পেয়ে আমি এবং ইকবাল বাহার সোহেল মধ্যরাতে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। আলাপ প্রসংগে জানালেন, তাঁর ছেলেবেলার ক’টি বছর কেটেছে এই অধ্যক্ষ বাংলোয়। ১৯৫০ থেকে ’৫৩ পর্যন্ত তাঁরা আব্বা মরহুম আবু হেনা ছিলেন এই কলেজের অধ্যক্ষ এবং এখান থেকেই অবসর দেন।
তখন সিলেট অঞ্চলে প্রচুর গাছ-গাছালী ছিলো। কলেজের চারপাশ আজকের মতো লোকালয়পূর্ণ ছিলো না। ঘন অরণ্যে আচ্ছাদিত ছিলো। টিলার উপরের বাংলোয় দাঁড়িয়ে দূরে তাকালে দেখা যেতো শুধু গাছ আর গাছ। এসব গাছের ঝোঁপে তাঁরা লুকোচুরি খেলতেন, অরণ্যের ভেতর থেকে কাউকে খোঁজে বের করা ছিলো দুরূহ ব্যাপার। বিচিত্র পাখি, সাপ, বানরসহ অনেক বন্য প্রাণী তখন দেখা যেতো। শীতে পাহাড় থেকে বাঘ নেমে আসতো। আবহাওয়া ছিলো-গরমের সময় প্রচন্ড গরম, বৃষ্টির সময় অঝোর ধারার বৃষ্টি, শীতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা-ফায়ার প্লেসে আগুন জ¦ালিয়ে ঘর গরম করতেন।
সে সময় সিলেট গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে পড়তেন। বাইসাইকেলে স্কুলে যাওয়া-আসা। আজকের সিলেট-তামাবিল রোডের নাম ছিলো-শিলং রোড। রংমহল সিনেমা হলের কাছে বাসে চড়ে লোকজন শিলং যেতো। রাস্তায় দু’পাশে ছিলো ঘন অরণ্য। সন্ধ্যার পর এ রাস্তায় সাইকেল চালালে মনে হতো কোন টানেল দিয়ে পথ চলছেন, মিটি মিটি আলো জে¦লে জোনাকী পোকা হতো সাথী। বৃষ্টি এলে দাঁড়াবার মতো কোন জায়গা পাওয়া যেতো না, তাই সব সময় ছাতা থাকতো হাতে।
এখন সিলেটের সেই বৃক্ষরাজী নেই। মানুষই বিনাশ করে চলেছে একে। তামাবিল রাস্তার পাশের সারিবাঁধা গাছগুলো কাটা হচ্ছে অবাধে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের যে বিপর্যয় ঘটছে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ ভবিষ্যত।
তিনি বললেন, ‘সিলেটের সেই অরণ্যরাজীর সৌন্দর্য্য ফিরিয়ে আনার এখনো অবকাশ আছে। আমরা যদি একটু যতœশীল হই-পতিত ভূমি ভরে দিই গাছ রুয়ে এবং সংরক্ষণ করি-তবে নিজে বাঁচবো, নতুন প্রজন্মকে উপহার দেবো একটি সুন্দর পৃথিবী।’