আম্মা বলে কেউ আর ডাকবে না…
সিলেট এক্সপ্রেস
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ জুলাই ২০২২, ৯:০০ মিনিট
তাসলিমা খানম বীথি :
১ অফিস থেকে বের হয়ে রিকশা না পেয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আম্বরখানা দিকে। চৌহাট্টা যেতেই কিছুটা যানজট থাকায় হাঁটতে পারছিলাম না। হঠাৎ শুনতে পাই ‘আমার আম্মার লাগি রাস্তাটা বড়ো খরা লাগবো’ গলা শুনে বুঝতে পারলাম রাহমান চাচা। কারন তিনি ছাড়া আমাকে কেউ আর আম্মা বলে ডাকে না। পাশে তাকাতেই চাচা মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে বললেন ‘কিতা গো রিকশা পাইরানানি’ আমিও পাইরাম না। চল বাপবেটি হাটিয়া আম্বরখানা যাইগি। তারপর চাচা আর আমি হাঁটছি আর কথা বলছি। কথা বলা শুরুতে চাচার ভ্রমন বিষয়ক ‘বিলেতে গ্রামে’ বইটি নিয়ে আমি আলোচনা সমালোচনা করি। আমার আলোচনা শুনে খুশিতে চাচার চোখ দুটো চিকচিক করছিল। কথা বলতে বলতে আমি আর চাচা আম্বরখানা চলে আসি। আম্বরখানা পয়েন্টে আসতেই চাচা বলল- ‘কিতা খাইতা কও’ আমি বললাম- কিছু খাবো না। চাচাকে ধন্যবাদ দেবার আগেই খুব জোর করছিলেন খেতে। পরে আর না করতে পারলাম না। চাচা আর আমি মিলে একটি রেস্টেুরেন্টে বসে নাস্তা করি। সেখানে বসেও চাচা তার বই নিয়ে কথা বলে। তার ইচ্ছে বিলেতে গ্রামে বইটি দ্বিতীয় সংখ্যাটি ভালোভাবে এডিট করে বের করবেন।
২.ফর্সা চেহারা, চকচকে, ঝকঝকে পরিপাটি সেদিনের মুখটি আজো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চাচার সাথে আমার পরিচয় হয় সিলেট সেন্টার ফর ইনফরমেশন এন্ড মাসমিডিয়া (সিফডিয়া)’র মাধ্যমে। একদিন বস এর চাচাতো বোনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় চাচা এসে হাজির অফিসে। তখনও আমি তাকে চিনতাম না। আমাদের দুজনের আড্ডা চাচাও যোগ দেন তখন এনি আপা চাচার সাথে পরিচয় করে দেন আমাকে। আপা তাকে চাচা বলে ডাকতেন তাই আমিও চাচা বলে ডাকি। তারপর থেকে যখন চাচার সাথে দেখা বা কথা হতো আমাকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতেন। কোনদিন তিনি নাম ধরে ডাকেননি আমাকে।
৩. যেদিন জানতে পারলাম রাহমান চাচার শরীরের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সেদিন থেকে মনের ভেতর ভয় লাগছিল। চাচা অসুস্থ হবার পর মাঝে মাঝে তার অসুস্থতার নিউজ আপডেড করতাম তখন প্রচন্ড মন খারাপ হতো। মনে মনে ভাবতাম হয়তো পরের নিউজটি তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন এই লিখে আপডেড করব। ইচ্ছে তাকার সত্ত্বেও তাকে সরাসরি দেখতে বাসায় কিংবা হাসপাতালে যেতে পারিনি। কারন ক্যান্সার হবার পর থেকে চাচার মুখটি আগের মত ছিলো না। তার শরীরে ক্যান্সার এটি মেনে নিতে পারব না বলে তাকে দেখতে যাইনি।
৪. সেদিনেও অফিস থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের মত রিকশা না পেয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ সামনে এসে একটি রিকশা থামলো ‘আম্মা আমার লগে যাইতানিগো, আম্বরখানা নামাইয়া দিমুনে’ ফিরে তাকাতে দেখি রাহমান চাচা। তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বাধলেও খোচাখোচা দাড়ি, মলিন মুখটি সেই আগের মত আমার কাছে প্রানবন্ত লাগছিল। তার মুখে ছিল চিরচেনা সেই হাসিটি। ধন্যবাদ দিয়ে চাচাকে বললাম- না- আমি যেতে পারব। তখনও ভাবিনি চাচা সত্যি সত্যি না ফেরার দেশে চলে যাবেন।
৫. ২৫ জুলাই ২০১৬। বিকেলে যখন অফিসে কাজ করছিলাম তখন বস এর ফোন। হ্যালো বলার আগেই তিনি বললেন, সাংবাদিক আবদুর রাহমান মারা গিয়েছেন। তার মৃত্যু নিউজ সিলেট এক্সপ্রেসে আপডেড করার কথা বলে মোবাইলের লাইন কেটে দেন। চাচার মৃত্যু সংবাদটি শুনে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু সংবাদ আমাকেই করতে হবে। কোনদিন কল্পনাও করিনি। কেন জানি ইচ্ছে করছিল না চাচার মৃত্যু সংবাদটি টাইপ করতে। মেনে নিতে পারছিলাম না তার মৃত্যু। সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে কাছের মানুষটি মৃত্যু সংবাদ যখন করতে হয় তখন বুকের ভেতর কতটুকু রক্তক্ষরণ হয় তা শুধু আমরা সংবাদকর্মীরাই জানি। চাচার নিউজ করতে গিয়ে যখন চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। তখন বুঝতে পারলাম তিনি কতটুকু আমাকে ভালোবাসতেন। তার ¯েœহ, ভালোবাসাকে প্রচন্ডভাবে অনুভব করছিলাম। সেই সময় চাচার সাড়ে তিন বছর বয়সী একমাত্র মেয়ের কথা মনে পড়ছিল। সে হয়তো এখনো তার বাবার অপেক্ষায় আছে। হয়তো ভাবছে বাবা আসলে তাকে জড়িয়ে ধরবে। তার খুলে ওঠবে, একসাথে খাবে, তার সাথে খেলবে। বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়াবে। ছোট্ট জীবনে বাবাকে নিয়ে না জানি সে কত স্বপ্ন দেখছে। রাহমান চাচার মেয়েটি এখনো অনেক ছোট। সে একদিন বড় হবে। বাবার আদর, ভালোবাসা, ¯েœহ একটি মেয়ের জীবনে চলাপথে এগিয়ে যাবার জন্য কতটুকু প্রয়োজন যখন তা অনুভব করবে তখন তার মুখের হাসিটি হয়তো চলে যাবে। হয়তো কখনও সুখের দেখা পেয়ে হাসতে চেষ্টা করবে কিন্তু প্রিয়জন হারানোর বেদনা তার মুখের হাসিটি কোন না কোন ভাবে মলিন করে রাখবে।
৬. একজন নারীকে বিউটি পার্লারে সাজিয়ে, স্বর্ণালংকার ও সুন্দর জামা পরালে কেমন লাগে বলুন তো? অবশ্যই অপরূপ, অপূর্ব। বৃটেনের গ্রাম তেমনই অপরূপ রমনীর মত সাজানো। বিলেতের গ্রামের গল্প যেন এক অপরূপা রমনীর গল্পই। একদিন ছুটির দিনে ‘বিলেতে গ্রামে’ বইটি নিজের দেশে, নিজের ঘরে বসে যখন পড়ছিলাম তখন মনে হয়েছে ‘বিলেতের গ্রামে’ অলিতে গলিতে, গাছ গাছালি, পাক পাখালি, বাড়ির পাশের পুকুর, বরফগলা কালো ছোট্ট মেঠোপথে আমিও যেনো হেঁটে বেড়াচ্ছি। ‘বিলেতে গ্রামে’ ভ্রমন বিষয়ক বইটি যে কোন পাঠক পড়লে তাকে আর বিলেতে গিয়ে গ্রাম দেখতে হবে না। বইটি পড়লে ‘বিলেতে গ্রামটি’ ভ্রমন করা হয়ে যাবে। ২০১৪ সালে অটোগ্রাফসহ বইটি দিয়েছিলেন রাহমান চাচা। বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মানুষ তার কর্মে মাঝে বেঁচে থাকে আজীবন। রাহমান চাচাও আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে একটাই প্রার্থনা মরণব্যাধী ক্যান্সার যেন আর কোন প্রিয় মানুষকে হারাতে না হয়।
চাচা যেখানেই থাকেন না কেন। ভালো থাকবেন। ‘আম্মা’ ডাকটি সারাজীবন খুব…খুব মিস করব। আপনার মত করে ‘আম্মা বলে কেউ আর ডাকবে না’…।
তাসলিমা খানম বীথি
সিলেট এক্সপ্রেস।
20.7.2022